১.
“মে ইট প্লিজ ইয়োর অনার, এই মোকদ্দমায় নালিশি জমিতে বাদীপক্ষের নিরঙ্কুশ স্বত্ব ও দখল রয়েছে। বিবাদীদের কোনো কিছু না থাকা সত্ত্বেও গায়ের জোরে বেদখলের হুমকি দিচ্ছে। বিবাদীদের ক্রিমিনাল রেকর্ড খুব খারাপ। তাদের এরূপ কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি তা কার্যকরকরণে পুলিশি সহায়তা প্রয়োজন।”
আজ থেকে ৮/৯ বছর আগের ঘটনা। আমি তখন রংপুরের সিনিয়র সহকারী জজ। বিজ্ঞ আইনজীবীর সাবমিশন ও রেকর্ড দেখে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মনস্থির করলেও এরূপ আদেশের সাথে পুলিশি সহায়তার বিষয়টি সম্পূর্ণ নতুন মনে হলো। কেননা এ ধরনের দরখাস্ত আগে কখনও পাই নি; কেউ এরূপ আদেশ দিয়েছেন বলে শুনিও নি।
বিজ্ঞ আইনজীবীকে প্রশ্ন করতেই তিনি ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের একটি নজির উপস্থাপন করে জানালেন, আদালতের আদেশ কার্যকর করার উদ্দেশ্যে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়ার বিস্তৃত এখতিয়ার সিভিল কোর্টের রয়েছে। তিনি আরো জানালেন, সম্প্রতি এই জেলার বদরগঞ্জ সহকারী জজ আদালতের একটি মামলায় মাননীয় হাইকোর্টও এমন আদেশ দিয়েছেন। ব্রেকের পরে আদেশ দেওয়া হবে বলে নেমে গেলাম।
মধ্যাহ্ন বিরতিতে জজ কোর্টের লাইব্রেরিসহ আশেপাশে খোঁজ করে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞায় পুলিশি সহায়তার বিষয়ে আইন ও নজির খুঁজে পেলাম না। পুনরায় রেকর্ড দেখে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশের সাথে পুলিশি সহায়তার জন্য থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়ে আদেশের কপি প্রেরণ করা হলো। পরের দিন অপ্রত্যাশিতভাবে মিঠাপুকুর থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মহিনুল ইসলাম সাহেব আদালতে হাজির। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং এই সংক্রান্তে তার করণীয় বিষয়ে জানতে চান। আদালতের আদেশ তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হওয়ায় সেদিন অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছিল।
২.
গত এক সপ্তাহ যাবৎ সম্প্রতি প্রকাশিত অনুজপ্রতীম বিজ্ঞ বিচারক মারুফ আল্লামের ‘অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগবিধি’ বইটি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। পড়তে পড়তে মানসপটে সেই স্মৃতিটাই ভাসছিল। গভীরভাবে অনুধাবন করলাম সে সময় এমন একটা বই পেলে কতই না উপকৃত হতাম। কেননা বইটিতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা কার্যকরকরণে পুলিশি সহায়তা প্রদানে মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগের সেই রায়টা খুঁজে পেলাম (পৃষ্ঠা-২৩২)। বইটিতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত খুঁটিনাটি বিষয়াদিসহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মোট ১৭টি অধ্যায়ে আইন ও অসংখ্য নজিরের আলোকে সাজানো হয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দরখাস্তের রক্ষণীয়তা, দখল নিরূপণের কৌশল, উক্তরূপ দরখাস্ত দ্রুত নিষ্পত্তির উপায়, সংক্ষুব্ধ পক্ষের প্রতিকার সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে।
সবচেয়ে ভালো লেগেছে, মামলা চলাকালে কোনো পক্ষ বেদখল হলে ডিক্রি পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই কিভাবে অস্থায়ী নির্দেশমূলক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে দখল উদ্ধার করা যায় সে সম্পর্কিত লেখাটি পড়ে (ষষ্ঠ অধ্যায়, পৃষ্ঠা ৫০-৬৩)। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে রিসিভার, ভায়োলেশন ইত্যাদি কাটখোট্টা বিষয়াদি নিয়েও সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপিত হয়েছে। এসব প্রত্যেকটি বিষয়ের বাস্তবভিত্তিক সমস্যার উচ্চ আদালতের নজিরের আলোকে সমাধান, মডেল আদেশ, ফরম সংযোজন ইত্যাদি বইটির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য।
৩.
বিচারালয়ে দেখেছি, অনেক বিজ্ঞ আইনজীবী সিভিল প্র্যাকটিস না করলেও তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চাকুরি ও পদ সংক্রান্ত বিষয়, সরকারি উন্নয়নমূলক প্রকল্প সংক্রান্ত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ও ১৪৫ ধারায় জরুরি প্রতিকারসমূহের শুনানিতে অংশগ্রহণ করেন। তাদের জন্যও এই বইটি নিঃসন্দেহে সহায়ক হবে। কেননা, অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা ধরনের কিছু জরুরী প্রতিকার বিজ্ঞ নিবার্হী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে পাওয়া যায় বলে সে সম্পর্কিত একটি পৃথক অধ্যায়ও রয়েছে।
বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আদালতে দেখেছি, বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণের আদেশ লঙ্ঘনের প্রেক্ষিতে ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতিতে পেনাল কোডের ১৮৮ ধারায় অভিযোগ দেওয়ার কারণে আসামীরা অভিযোগ শুনানিকালেই অব্যাহতি পেয়ে যায়। এক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৫(১)(সি) ধারা মোতাবেক কিভাবে সঠিক পদ্ধতিতে নালিশ দায়ের করতে হবে তার নমুনাও পেলাম বইটিতে (পৃষ্ঠা-২১৫)। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি বইটি সংশ্লিষ্ট সকলের হ্যান্ডবুক হিসেবে কাজ করবে।
এছাড়া, বিভিন্ন জেলায় দেখেছি ভায়োলেশন মামলায় কারাদণ্ডপ্রাপ্ত প্রতিপক্ষের কারাবাসের জন্য দরখাস্তকারীকে খোরাকি ভাতা (subsistence allowance) পরিশোধ করতে হয়। লেখক বিভিন্ন আইন ও নজিরের আলোকে দেখিয়েছেন এ ধরণের বন্দিদের খোরাকি ভাতা সরকার বহন করবে (পৃষ্ঠা-১৪৫-১৪৭)।
৪.
এভাবে প্রতিটি পাতায় পাতায় প্রায়োগিক নতুন নতুন বিষয়ে আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ব্যতিক্রমী এই বইটি বিজ্ঞ বিচারক, বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, বিজ্ঞ আইনজীবী, পুলিশ, জেলার, আইনের ছাত্র-শিক্ষক এবং গবেষকদের কাজে লাগবে। বইটি গতানুগতিক আইন বইয়ের ধারাভিত্তিক আলোচনা নয়; বরং বাস্তব মামলার উদাহরণ অত্যন্ত সহজবোধ্য ভাষায় প্রশ্নোত্তর আকারে লেখা হয়েছে বিধায় বিচারপ্রার্থীদেরও পড়তে ভালো লাগবে।
সর্বোপরি, বইটি পড়তে গিয়ে দু’একটি মুদ্রণ প্রমাদ চোখে পড়েছে। আশা করছি, পরবর্তী সংস্করণে লেখক তা সংশোধন করে নেবেন। চমৎকার প্রচ্ছদের এই বইটি প্রকাশ করছে লেক্সিলেন্স। বইটি পাওয়া যাচ্ছে ঢাকাস্থ ইউনিভার্সেল বুক হাইজ, আমিন বুক হাউজ এবং রহিম বুক হাউজসহ বিভিন্ন লাইব্রেরীতে। বইটির প্রচ্ছদ মূল্য ৬০০ টাকা হলেও পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৩৯০ টাকায়।
বুক রিভিউ লেখক: মো. সাইফুল ইসলাম পলাশ; অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী।