মোঃ রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী: বর্তমানে ‘গ্রেপ্তার’ শব্দটি’ দেশের নাগরিকের মাঝে হয়ে উঠেছে আতঙ্ক, ভয় ও আলোচনার বিষয়। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটসহ ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা ব্যবসায়িক, সামাজিক সহিংসতার পাশাপাশি নানা কারণে গ্রেপ্তার শব্দটা এখন নিত্য বিষয়।
পাড়া-প্রতিবেশী, আত্বীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্খী-পরিচিতজন কিংবা আপনি নিজে গ্রেপ্তার সংক্রান্ত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হল সাধারণ মানুষরে আইন সম্পর্কিত ধারণা কম।
এছাড়াও ‘আইনের মারপ্যাচ বুঝি কম’ মনে করে অনেকেই এড়িয়ে যেতে চান। যার ফলে আইনি সমস্যায় হঠাৎ পতিত হলে বা গ্রেফতার হলে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন এবং পদে পদে বিভিন্ন ঝক্কিঝামেলা, হয়রানি, বিড়ম্বনা, নির্যাতন, নিপীড়ন, আত্যাচার, জুলুমের শিকার হন।
এজন্য একজন গ্রেফতার হওয়া নাগরিক যেসব আইনগত অধিকার পাবেন এবং গ্রেপ্তার পরবর্তী আইনি পদক্ষেপগুলো কী হবে, তা জানা থাকা দরকার। যা গ্রেপ্তার ও আটক অবস্থায় নাগরিক অধিকার ও পুলিশের কর্তব্য আইন দ্বারা নির্ধারিত ও সুরক্ষিত।
দেশের বিদ্যমান আইনসমূহে গ্রেপ্তার সংক্রান্ত বিধানগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোন ব্যক্তিকে তার স্বাধীনভাবে চলাফেরার ক্ষমতাসহ কতিপয় অধিকার হরণ করে আটক করার মাধ্যমে আইনের হেফাজতে বা আওতায় নেওয়াকে গ্রেপ্তার বলে।
এই আটক- গ্রেপ্তারে বিভিন্ন ধরণের হতে পারে যেমন- শাস্তি ভঙ্গের আশঙ্কায়, কৃত অপরাধের শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে অথবা নিরাপত্তা দানের উদ্দেশ্যে। তবে একজন ব্যক্তিকে যে কারণেই গ্রেপ্তার করা হউক না কেন তাকে কোনভাবেই আইনগত অধিকারসমূহ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
গ্রেপ্তারের নিয়ম এবং গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির আইনগত অধিকার সমূহ সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মামলা ব্লাষ্ট বনাম বাংলাদেশ, দেশের পবিত্র সংবিধান, ফৌজদারি কার্যবিধি, পিআরবি, দন্ডবিধি, ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’সহ বেশ কিছু আইনে সুস্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে;
১. কোন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ নিজের পরিচয় দিবে এবং প্রয়োজনে উপস্থিত অন্যান্য ব্যক্তিকেও তার পরিচয়পত্র দেখাবেন এবং কারণ দর্শাবেন অর্থাৎ গ্রেপ্তার হওয়া নাগরকিরে এ অধিকার আছে যে, কোন কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে এবং তার গ্রেপ্তারের জন্য কোনো ওয়ারেন্ট আছে কিনা।
তার মানে এই নয় যে, গ্রেপ্তার করতে হলে অবশ্যই ওয়ারেন্ট লাগবে। কারণ ফৌজদারি কার্যবিধি বলা হয়েছে যে, পুলিশের যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ হলে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার করা যাবে।
২. আর যদি পুলিশ ব্যতীত কোন সাধারণ নাগরিক বা ব্যক্তিবর্গ অপরাধকারী ব্যাক্তিকে বা অপরাধী বলে ঘোষিত কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেন, সেক্ষেত্রে দেরি না করে তাকে যতদ্রুত সম্ভব নিকটস্থ পুলিশ অফিসারের কাছে অর্পণ করবেন অথবা পুলিশ অফিসার না থাকলে তাকে থানা হেফাজতে দিবে।
৩. যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া কোন পুলিশ অফিসার গ্রেপ্তার কার্যকর করতে গিয়ে কোনভাবেই শারীরিক বা মানসিক আঘাত করতে পারবেন না। আর যদি করতেই হয় তাহলে তা যতটুকু প্রয়োজন ঠিক তার অধিক করা যাবে না।
৪. গ্রেপ্তার কার্যকর করতে গিয়ে আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে উক্ত ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম, বা সম্পত্তির হানি ঘটে।
৫. গ্রেপ্তারকারী কর্মকর্তা গ্রেপ্তারের পরে দেহতল্লাশী করতে পারেন এবং দেহ তল্লাশী করে প্রয়োজনীয় পরিধেয় বস্ত্র ব্যতীত যে সকল মালামাল তাঁর নিকট পাওয়া যাবে, তা নিরাপদ হেফাজতে রাখবেন এবং একটি তালিকা তেরি করে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে অবহিত করতে হবে।
৬. যদি কোন মহিলা গ্রেপ্তার হয়, তাহলে অবশ্যই অপর কোন মহিলা দ্বারা তার দেহ তল্লাশী করতে হবে। নারীদেহ তল্লাশীর সময় সব ধরনের শালীনতা রক্ষা করতে হবে এবং সে সময় কোনো পুরুষ সেখানে উপস্থিত থাকতে পারবেন না।
৭. কোনো নারীর হাতে যদি ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে শাঁখা বা কাচ বা লোহার চুড়ি থাকে, তা খুলতে বলা যাবে না। তল্লাশী সম্পন্ন হওয়ার পর যেসব জিনিস আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত কর্মকর্তা হেফাজতে নেবেন, তার একটি তালিকা প্রস্তুত করে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে অবহিত করে তাতে তার স্বাক্ষর নিতে হবে।
৮. গ্রেপ্তারের পর আটক ব্যক্তিকে হাতকড়া পরানো হয়। পুলিশের হাতকড়া ব্যবহারের জন্য নিয়মকানুন সম্পর্কে বলা হয়েছে, কিন্তু আটককৃত ব্যক্তি যদি মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ বা অসুস্থ হয় তাহলে তাকে হাতকড়া পড়ানো যাবে না।
৯. জামিনযোগ্য মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তির ক্ষেত্রে হাতকড়া ব্যবহার করা যাবে না। কোনো সাক্ষীকে আদালতে উপস্থিত করার জন্য পরোয়ানা জারি করা হলে ওই সাক্ষীকেও হাতকড়া পরানো যাবে না। অ-জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার পরিমাণ বিবেচনায় রেখে হাতকড়া পরাতে হবে।
১০. থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গ্রেপ্তারকৃত সব ব্যক্তির নিরাপদ জিম্মার জন্য দায়ী থাকবে। কোনো ব্যক্তিকে থানায় আনার পর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রথম দায়িত্ব থাকে গ্রেপ্তার নারী ও পুরষ বন্দীদের হাজতে আলাদা থাকার ব্যবস্থা করা।
১১. গ্রেপ্তার ব্যক্তির হাজতখানা থেকে পলায়ন বা আত্মহত্যার কাজে সহায়ক হতে পারে, এমন কোন বস্তু লুকানো আছে কি না, তা নিবিড়ভাবে তল্লাশী করে দেখতে হবে। সেই সঙ্গে বন্দীর দেহে আঘাতের চিহ্ন আছে কি না, তা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা। এমন আঘাতের চিহ্ন পরীক্ষা করার সময় অবশ্যই উপযুক্ত ব্যক্তি বা সাক্ষীর সামনে করতে হবে।
১২. যদি আঘাতের চিহ্ন থাকে, তবে দ্রততম সময়ে চিকিৎসার জন্য থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিকটতম হাসপাতালে প্রেরন করবেন এবং চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করবেন। চিকিৎসকের এমন প্রত্যয়নপত্রের কপি গ্রেপ্তার ব্যক্তিকেও সরবরাহ করতে হবে।
১৩. থানায় গ্রেপ্তার ব্যক্তির যেকোনো প্রকার ক্ষতির জন্য থানা কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে। থানা হাজতে থাকার জন্য অন্তত ৩৬ বর্গ ফুট স্কেল বিশিষ্ট জায়গা দিতে হবে। হাজতে কোনরকম আহত বা অসুস্থ হলে তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে এবং সুপেয় পানি ও খাবার সরবরাহ করতে হবে।
১৪. গ্রেপ্তারের পর কোন প্রকারের শারিরীক নির্যাতন বা নিষ্ঠুর ব্যবহার করা যাবে না। জোর করে কোন স্বীকারোক্তি আদায় করা যাবে না। গ্রেপ্তারের সময় বিনা কারণে যদি পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে কোন প্রকার আঘাত দান, ক্ষতি বা লাঞ্ছনা করা একটি অপরাধ এবং বাংলাদেশ সংবিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানে কাউকে নির্যাতন করা নিষিদ্ধ বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’
১৫. গ্রেপ্তারের পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দ্বারা নির্যাতনের অভিযোগ ওঠায় সরকার ২০১৩ সালে ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’ প্রণয়ন করে। যেখানে আইনি হেফাজতে নির্যাতন একটি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবং নির্যাতনকারী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
১৬. গ্রেপ্তারের সময় যদি গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির বন্ধু বা নিকটাত্মীয় পাশে না থাকেন, তবে গ্রেপ্তারের পরে যত দ্রুত সম্ভব গ্রেপ্তার ব্যক্তির বলে দেওয়া আত্মীয় বা বন্ধুকে গ্রেপ্তারের তারিখ, সময় ও হেফাজতে রাখার স্থান (থানার নাম) অবহিত করতে হবে।
১৭. গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির ইচ্ছানুযায়ী পুলিশ তার পছন্দমত আইনজীবী বা নিকটাত্মীয়রে সঙ্গে পরামর্শ করতে বা দেখা করতে দিতে হবে। আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিজ্ঞ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করাতে হবে।
১৮. কোনো পুলিশ অফিসার যদি কাউকে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করে, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত ২৪ ঘণ্টার বেশি নিজের হেফাজতে রাখতে পারবে না। ২৪ ঘণ্টার আগেই ধৃত ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করতে হবে ।
১৯. গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ বা তথ্যগুলো যুক্তিসংগত এবং তাকে জেলে রাখার যথেষ্ট উপকরণ মামলার কাগজপত্রে রয়েছে এমন পরিস্থিতিতে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেবেন, অন্যথায় তাৎক্ষণিকভাবে তাকে মুক্তির আদেশ দিবেন।
২০. গ্রেফতার ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে করতে হবে। জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। ব্লাষ্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় রিমান্ড সর্ম্পকে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। তবে ১৫ দিনের বেশি পুলিশ হেফাজতে (রিমান্ড) রাখা যাবে না।
২১. যদি কোন শিশুকে গ্রেপ্তার করা হয় তাহলে শিশু আইনের ৪৮ ধারা মোতাবেক তাকে জামিন দিতে হবে। শিশুদের বড়দের সাথে বিচার করা যাবে না, শিশুদের জামিন দিতে হবে, কারাদন্ড দেয়া যাবে না এবং সংশোধনমূলক প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে হবে।
২২. আসামীর অপরাধটি যদি জামিন যোগ্য হয় তাহলে অবশ্যই তাকে জমিনে মুক্তি দিতে হবে। বিশেষ ক্ষেত্রে জামিনের অযোগ্য অপরাধেও জামিন দিতে হবে সুবিবেচনা সাপেক্ষে।
২৩. আদালতে বা বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট এর নিকট দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে বাধ্য করা যাবে না। অভিযুক্ত ব্যক্তি রাজসাক্ষী হতে পারিবেন। সাফাই সাক্ষী নিতে গিয়ে শপথ নেয়া যাবে না।
২৪. গ্রেফতার ব্যক্তি শ্রেণীভুক্ত হয়ে বিশেষ সুবিধা নিতে পারবে। যে কোন রিপোর্টের নকল পাবে। বিচারে দোষী সাব্যস্থ না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ দাবী করতে পারবে এবং তাঁকে আসামী বলা যাবে না। আনীত অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব চাপানো যাবে না। অভিযুক্তের উপস্থিতিতে সাক্ষ্য গ্রহণ করতে এবং বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
২৫. পুলিশ থেকে ম্যাজিস্ট্রেট সবাই দ্রত বিচারের ব্যবস্থা করবেন। বিচার পরবর্তী নির্দোষ হলে বেকসুর খালাস দিতে হবে। কোন অমানবিক বা নিষ্ঠুর দন্ড দেওয়া যাবে না।
২৬. যদি আদালতের রায়ে অসন্তুষ্ট হন তাহলে আসামী আপীলের সুযোগ পাবেন। দন্ডিত হওয়ার ক্ষেত্রেও জামিন পাবে।
২৭. হাইকোর্টের অনুমোদন ছাড়া মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা যাবে না।
২৮. গর্ভবতী মহিলার ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ড স্থগিত রাখতে হবে।
২৯. যে কোন ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের অধিকার থাকবে।
৩০. একই অভিযোগে কোন ব্যক্তিকে দুইবার বিচারের আওতায় আনা যাবে না।
এসবই হচ্ছে সংক্ষপে মোটামুটি একজন গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির তথা নাগরকিরে আইনগত অধকিার। সবশেষে বলব, আসুন সবাই আমাদের আইনগত নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ হই, দেশের আইনকানুন জানি এবং মেনে চলি।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। ইমেইল: advraihanulwazedchy@gmail.com