বিচার বিভাগ ও বিচারক সম্পর্কে কথাবার্তা বলার ক্ষেত্রে সংযত ও দায়িত্বশীল হতে হবে—এক শুনানিতে এ কথা বলেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। চারটি মামলায় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায়ের আগাম জামিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানিতে মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) আদালত এ কথা বলেন।
তিনটি মামলায় আগাম জামিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন শোনেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় করা অপর মামলায় জামিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন শোনেন আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ। শুনানি নিয়ে নিপুণ রায়কে হাইকোর্টের দেওয়া আগাম জামিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা পৃথক আবেদন খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন। নিপুণের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী নিতাই রায় চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন ও মো. রুহুল কুদ্দুস।
প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় করা মামলার অভিযোগ শুনানিতে বক্তব্য তুলে ধরেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন। একপর্যায়ে আদালত বলেন, ‘হাইকোর্ট জামিন দিয়েছেন, আপত্তি কোথায়?’ তখন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘অস্থিরতা সৃষ্টিতে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন।’ আদালত বলেন, ‘কত দিন জামিন দিয়েছেন?’ তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আগামী ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত।’
এরপর নিপুণের পক্ষে শুনানি শুরু করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা। তাঁর উদ্দেশে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, ‘যে ধারাগুলো জামিনযোগ্য, সেসব ধারার মামলায় হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নেওয়ার মতো বিষয় হলো? জামিনযোগ্য ধারার অভিযোগে যদি হাইকোর্টে জামিনের জন্য আসেন, হাইকোর্ট যদি এগুলো গ্রহণ করেন, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থাকার দরকার কী?’
আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বলেন, ‘আমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। রাষ্ট্রপক্ষ পিক অ্যান্ড চুজ (পছন্দমতো তুলছে) করছে। কারওটি এখানে (আপিল বিভাগে) নিয়ে আসছে, কারওটি আনছে না।’ এতে আপত্তি জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘আমরা আবেদন করেছি, যা বিচারাধীন।’
এক পক্ষ নিন্দা জানাল, আরেক পক্ষ দেখল ষড়যন্ত্র
শুনানিতে এম বদরুদ্দোজা বলেন, ‘নিপুণ রায় এই অপরাধ করেছে, পুরো এজাহারের কোথাও তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই।’ আদালত বলেন, ‘তাহলে তো এটি ভালো যুক্তি। আপনি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যাবেন, জামিন হয়ে যাবে।’
শুনানির এক পর্যায়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, ‘আগাম জামিন বিষয়ে আপিল বিভাগের গাইডলাইন রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক, হাইকোর্ট গাইডলাইন অনুসরণ করে না। আপনাদের মতো সিনিয়ররা যান, আপনারা বলেন, হাইকোর্ট এন্টারটেইন (গ্রহণ) করেন। আমাদের গাইডলাইন ঠিকমতো ফলো হয় না।’
নিপুণের আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বলেন, ‘এই মামলাগুলো রাজনৈতিক, রাজনৈতিক কারণে মামলা।’ একপর্যায়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির বাসায় হামলা হলো। আপনারা বার (আইনজীবী সমিতি) সম্মিলিতভাবে একটা কথা বলতে পারলেন না। এক পক্ষ নিন্দা জানাল, আরেক পক্ষ ষড়যন্ত্র দেখলেন।’
তখন আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির বাসায় হামলা নিন্দনীয়। আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন এখানে।’ তাঁর উদ্দেশে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, ‘একটা বাড়ি, কিছু কিছু জায়গা আছে প্রতীক।’
এম বদরুদ্দোজা বলেন, ‘এটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, তিনি কোনো দলের না। জুডিশিয়ারির প্রধান। ওনার বাড়িতে হামলা নিন্দনীয়। কিন্তু যারা করেছে, সিসিটিভির ফুটেজ দেখে তাদের ধরা উচিত ছিল।’
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, ‘এখন হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ—ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইউটিউব। কে কী হিরোইজম করেন, সেটি আবার দেখাবার জন্য ফেসবুকে পোস্ট করে। কে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কে রড নিয়ে।’ শুনানি নিয়ে ওই মামলায় জামিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।
‘আপনারা নিজেদের সংযত রাখেন’
শুনানির এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘ক্রমাগতভাবে জুডিশিয়ারির (বিচার বিভাগের) বিরুদ্ধে বিষোদ্গার হচ্ছে, ঢাকা কোর্টে বোমা, বিচারকদের বিরুদ্ধে মন্তব্য, সর্বোচ্চ আদালতে বিচারকের পদত্যাগ দাবি, বক্তৃতা বিকৃত করে কথা বলা—একের পর এক এই ঘটনাগুলো ঘটছে অবশ্যই বিচার বিভাগের ওপরে আক্রমণ করে। রাজনৈতিক নেতারা কর্মরত বিচারপতি নিয়ে কথা বলেন।’
নিপুণের পক্ষে থাকা তিনজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর (সমিতির সাবেক সম্পাদক) উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কেন বলছি? আপনারা সব আইনজীবীর আস্থা অর্জন করে এসেছেন। এখন কী হচ্ছে? একের পর এক কথা বলছেন। আপনারা নিজেদের সংযত রাখেন। আপনারা যদি নিজেদের সংযত রাখেন, যদি না বলেন, তাহলে মানুষও শ্রদ্ধাশীল হবে। আর আপনারা যদি বলতে থাকেন, তাহলে শ্রদ্ধা থাকবে না।’
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, ‘সবাই কিন্তু আইনের আশ্রয় নিয়ে আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার পায়।’ তখন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘অবশ্যই। বিচার বিভাগ শেষ আশ্রয়স্থল।’ বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন, ‘এটি হয়তো কখনো একটু সময় নেয়। সুতরাং এই জায়গাটি সমুন্নত রাখতে হবে। জামিন নিয়ে গিয়েই একই ব্যক্তি আবার কোর্টের বিরুদ্ধে বলতে থাকে। বিচার বিভাগ ও বিচারক সম্পর্কে কথাবার্তা বলার ক্ষেত্রে সবাইকে সংযত ও দায়িত্বশীল হতে হবে।’
এরপর নিপুণের আগাম জামিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা অপর তিনটি আবেদন খারিজ করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ।