দীপজয় বড়ুয়া: বহুকাল থেকেই অপরাধ জগৎ বড় বিচিত্র। অপরাধীকে খুঁজে বের করা পুলিশের বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর অপির্ত। কিন্তু কখনো কখনো অপরাধের রহস্য উদঘাটন করা পুলিশের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ধৃত আসামি সহজে মুখ খুলতে চায় না। তখন পুলিশ অপরাধীকে মুক্তির প্রলোভন দেখিয়ে সত্য ঘটনা বলার জন্য সাক্ষী করার প্রস্তাব দেয়। আসামি রাজি হলে তাকে রাষ্ট্রের পক্ষে সাক্ষী করা হয়।
সুতরাং বলা যায় ‘রাজসাক্ষী’ মানে রাজ্যের সাক্ষী। যেহেতু সাক্ষ্য আইন প্রণয়নের সময় রাজার ‘রাজ্য প্রথা’ ছিল, সেহেতু এ ধরনের সাক্ষীকে ‘রাজসাক্ষী’ বলা হতো। এখন রাজাও নেই রাজত্ব প্রথাও নেই। তাই রাজসাক্ষীকে বতর্মানে ‘রাষ্ট্রের সাক্ষী’ বলা হয়। যাকে ‘রাজসাক্ষী’ করা হয় তার বক্তব্য গ্রহণ করার জন্য অন্যান্য নিরপেক্ষ সমথর্নযোগ্য সাক্ষীও থাকে।
সাধারণ অর্থে বলা যায় যে, যে অপরাধী, প্ররোচক বা জড়িত হিসেবে অপরাধের বিষয়ে বা প্রত্যেক সহ অপরাধীর (Accomplice) বিষয়ে তার জ্ঞানের মধ্যে থাকা সকল ঘটনার সম্পূর্ণ ও সত্য বিবরণ প্রকাশ করবে, এই শর্তে তাকে বিচারক ক্ষমার প্রস্তাব দিতে পারেন। ফৌজদারী মামলাতে এই সুযোগপ্রাপ্ত ধীকে রাজসাক্ষী (Approver) বলা হয়। যদিও সাক্ষ্য আইনে রাজসাক্ষী কথাটি সংজ্ঞায়িত করা নেই।
কোনো আসামি রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিতে রাজি হলে প্রথমে তাকে ‘রাজসাক্ষী’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং পরে কারাগারে রাখা হয় যাতে অন্য কোনো অপরাধী বা ব্যক্তি তাকে প্রভাবিত করতে না পারে। এ প্রসঙ্গে সাক্ষ্য আইনের ১৩৩ ধারায় বলা হয়েছে, অপরাধী অন্য সহযোগী অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করার উপযুক্ত ব্যক্তি বলে বিবেচিত হতে হবে। দুষ্কমের্র সহযোগীর অসমথির্ত সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আসামিকে সাজা দেয়া হলে তা বেআইনি বলে গণ্য হবে না। এ ধারা মতে আসামিকে যিনি রাজসাক্ষী হবেন তাকে ক্ষমা প্রদশের্নর ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে আসামি সাক্ষী হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
অন্যদিকে সাক্ষ্য আইনের ১৪৪ ধারার বিধান মোতাবেক রাজসাক্ষীর একক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আসামিকে শাস্তি প্রদান করা আইনত যুক্তিসঙ্গত হবে না। কেননা সে অন্যান্য সহযোগী অপরাধীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকে। কাজেই রাজসাক্ষীর মতো একজন বিশ্বাসঘাতক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণে আদালত বেশ সতকর্তা অবলম্বন করেন। আর আসামির সংখ্যা বেশি হলে এমনভাবে সাক্ষ্য প্রদান করতে হবে যাতে প্রত্যেক আসামির পৃথকভাবে অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।
অপরাধ দমনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আর একারণে অধিকাংশ অপরাধের মামলার বাদী রাষ্ট্র হয়ে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে জনগণের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ব্রিটিশ শাসনামলে বাদী হতেন রাজা। তাই গুরুতর অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি যারা আইনের সুযোগ নিয়ে সাক্ষী হয়ে রাজার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করতেন তারাই ‘রাজসাক্ষী’ হিসেবে গণ্য হতেন। কোনো একটি অপরাধ সংঘটনে যে সব ব্যক্তি জড়িত থাকে তাদের প্রত্যেককে অপরাধের সহযোগী বলা চলে।
অপরাধে সহযোগী সাধারণত সরকার থেকে ক্ষমার প্রতিশ্রুতি লাভ করে রাজসাক্ষীতে পরিণত হয় এবং সে কারণে সরকারের পক্ষাশ্রিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাক্ষ্যের অভাবে কোনো অপরাধী যাতে শাস্তি থেকে অব্যাহতি না পায় সে কারণে ফৌজদারি কাযির্বধির ৩৩৭ ও ৩৩৮ ধারায় কতিপয় শর্তসাপেক্ষে আসামিকে সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করার বিধান রয়েছে। গুরুতর অপরাধ সংঘটনকারীর কোনো সহচর যদি অপরাধের ঘটনা সম্পূণর্ভাবে প্রকাশ করে এবং নিজেকে জড়িয়ে সহচরদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করে তাহলে তাকে ‘রাজসাক্ষী’ বলে।
কেবল দায়রা আদালতে বিচারযোগ্য কোনো অপরাধ বা দশ বছর পযর্ন্ত কারাদণ্ডে দন্ডণীয় কোনো অপরাধ বা দণ্ডবিধির ২১১ ধারার অধীনে সাত বছর পযর্ন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ বা দন্ডবিধির ধারা ২১৬ক, ৩৬৯, ৪০১, ৪৩৫ ও ৪৭৭ক-এর কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে একজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা কোনো প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধটির তদন্ত অনুসন্ধান বা বিচারের কোনো পর্যায়ে অপরাধের সহযোগী কোনো ব্যক্তিকে এই শর্তের ক্ষমা করার প্রস্তাব দিতে পারেন যে অপরাধীদের সম্পকের্ গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগত বিষয়ে সত্য ঘটনা প্রকাশ করলে তাকে ক্ষমা করা যাবে। রাজসাক্ষীর দেয়া তথ্য পরবতীের্ত যদি অসত্য প্রতিপন্ন হয়, সেক্ষেত্রে সে ক্ষমা পাবে না।
রাজসাক্ষীর বিবৃতিতে দুটি উপাদান থাকতে হবে যথা ক) সে অপরাধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং খ) অন্য সব আসামির অংশগ্রহণ গুরুত্বপূণর্ বিষয় দ্বারা সমথির্ত। রাজসাক্ষী যদি আগে থেকে জামিনে না থাকে তাহলে তাকে বিচার শেষ না হওয়া পযর্ন্ত কারাগারে আটক রাখতে হবে। কারণ জামিনে থাকা রাজসাক্ষীর সাক্ষ্যের প্রকৃতি অনেকটা দুবর্ল। সহ-অপরাধী বা রাজসাক্ষীর বক্তব্যের ওপর নিভর্র করে সাজা দান করার ক্ষেত্রে আদালত সবোর্চ্চ সতকর্তা অবলম্বন করে এবং সাবির্কভাবে ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে আদালত বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজ করে থাকে।
রাজসাক্ষী সম্পর্কে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলার সিদ্ধান্ত নিম্নরূপ
22 DLR(SC) 106 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “প্রচলিত নিয়ম হইল রাজসাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে না যদি না গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঘটনার সংগে আসামীদেরকে জড়াইয়া স্বতন্ত্র সাক্ষী দ্বারা সমর্থন করা হয়”।
PLD 1959 kar 662 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “সাক্ষ্য আইনে রাজসাক্ষী উপযুক্ত সাক্ষী। তবে গৌণ ব্যাপারে সমর্থন বা আনুষাংগিক বিবরণের ভিত্তিতে তাহার সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কার্য করা নিরাপদ নহে”।
PLD 1920 ScMR 507 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ প্রথম পরীক্ষা হইল তাহার সাক্ষ্যে কোন সহজাত অসম্ভব কিছু নাই। যেক্ষেত্রে শুধু অপরাধমূলক বস্তু উদ্ধারই নয়, তাহার এবং আপীলকারী উভয়ের হাতেই জখম পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে আপীলকারীকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়”।
AIR 2000 Sc 908 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ যেক্ষেত্রে রাজসাক্ষী তাহার কৃতকার্য লুকানোর চেষ্টা করে নাই বরং আদালতের ঘটনার সঠিক ও সংগতিপূর্ণ বিবরণ দিয়াছে সেক্ষেত্রে দোষী সাব্যস্তের আদেশ সঠিক”।
PLD 1973 SC 595 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “রাজসাক্ষীর সমর্থন অপরাধের সকল বিষয়ে প্রয়োজন নাই। শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এবং আসামীর পরিচিতির বিষয়ে হইলেই যথেষ্ট”।
অপরাধের সহযোগী
সাক্ষ্য আইনের (The Evidence Act-1872) ১৩৩ নং ধারায় সহ অপরাধী, অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণের বিরুদ্ধে সাক্ষী হতে পারে এবং তার দেওয়া সাক্ষ্যে দোষী সাব্যাস্তকরণ কেবলমাত্র এই কারণে বে-আইনি হবেনা, যে তা অসমর্থিত সাক্ষ্যের (Uncorroborated Testimony) ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছে। সরকার পক্ষের এই সাক্ষ্যদানকারী সহ অপরাধীকেই প্রচলিত আদালত পরিভাষায় রাজসাক্ষী নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
14 DLR(SC) 174 Jafar Ali Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “দুষ্কর্মের সহযোগী কথাটির কোন সংজ্ঞা এই আইনে ব্যক্ত করা হয় নাই, তাই সাধারণ জ্ঞানে ইহার অর্থ করিতে হইবে। অপরাধ সংঘটনে যিনি অংশ নিয়াছিলেন তিনিই দুষ্কর্মের সহযোগী”।
রাজসাক্ষীর গুরুত্ব
সাক্ষ্য আইনের ১১৪ নং ধারা অনুসারে সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে যে রাজসাক্ষীর বয়ান যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য নয় যদিনা তা বিশিষ্টতায় পরিপূর্ণ বা সমর্থিত (Corroborated) হয়। সহ অপরাধী বা রাজসাক্ষীর বক্তব্যে নির্ভর করে সাজা দান করার ক্ষেত্রে সতর্কতা ও আদালতের বিচক্ষণতা কাম্য।
কে রাজসাক্ষী রাজসাক্ষী হতে পারে
এই ধারামতে রাজসাক্ষী হতে গেলে তাকে ১. অপরাধে সরাসরি জড়িত থাকতে হবে। ২. সে ফুল এণ্ড ট্রু কনফেশন দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে। ৩. যযে অপরাধের জন্য রাজসাক্ষী হবে তার শাস্তি কমপক্ষে দশবছরের কারাদণ্ড হতে হবে। ৪. মামলাটা কোর্ট অব সেশন দ্বারা পুরোপুরি সেশন কোর্ট দ্বারা ট্রাইয়াবল।
কখন রাজসাক্ষীকে বাতিল করা হয়
৩৩৯ ধারা (সি আর পিসি) মতে যখন পাবলিক প্রসিকিউটর বিশ্বাস করে রাজসাক্ষী ফুল এণ্ড ট্রু কনফেশন দিচ্ছেনা বা কোন কিছু ইচ্ছাকৃত গোপন করছে তখন তিনি রাজসাক্ষীকে বাতিল করার আবেদন করতে পারেন।
রাজসাক্ষীর সাক্ষ্যগতমূল্য
স্বাভাবিকভাবেই একজন রাজসাক্ষীর চারিত্রিক অবস্থা নিয়েপ্রশ্ন আসে। প্রথমত সে লোভি, দ্বিতীয়ত সে বিট্রেয়ার। সুতরাং তার সাক্ষ্যের স্টাটাস নিয়ে প্রশ্ন আসা স্বভাবিক।
কিন্তু সাক্ষ্য আইনের ১৩৩ ধারায় রাজসাক্ষীর সাক্ষ্যকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।
তথ্যসূত্র
১। Batuk Lal (২০০৪)। Law of Evidence। Allahabad: Central Law Agency। পৃষ্ঠা 427। Justice V. Ramkumar (7.06.16)। “Tendering perdon to an accomplice”। Live Law। ↑ Ayus Yadav (21.11.2011)। “Accomplice Witness and it’s Admissibility”। Legal India। Article in the ‘Bangalee’ 19th september, 1908। “Documents in the life of Sri Arabinda
২। আইন শব্দসমূহ-এডভোকেট মোঃ নাসির উদ্দিন, সাক্ষ্য আইনের ভাষ্য- গাজী মোঃ শামসুর রহমান, উইকিপিডিয়া,jjdn, দন্ডবিধি- বাসুদেব গাংগুলি, উকিপিডিয়া, সাক্ষ্য আইন- বাসুদেব গাংগুলি, সাক্ষ্য আইন- মোঃ জহিরুল হক, ফৌজদারী কার্যবিধি-জহিরুল হক, Section Wise 100 years Reference on Crpc, Section Wise 100 years Reference on Penal Code- Md. Abul Kalam Azad। Section Wise 100 years Reference Evidence Act- Mohammed Safiqur Rahman.