‘আই কুইট’! হোস্টেলের ঘরের দেওয়ালে কালো কালিতে লেখা ছিল ঠিক এই দু’টি শব্দ। সিলিংফ্যানে পেঁচানো ফাঁসে ঝুলছিল ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির সেই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া জয় লোবোর দেহ। প্রযুক্তিক্ষেত্রে ভারতের শীর্ষস্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি’র (আইআইটি) এমনই ঘটনা নিয়ে এ বার উদ্বেগ প্রকাশ করল দিল্লি হাই কোর্ট।
গত কয়েক বছরে আইআইটিতে একের পর এক পড়ুয়ার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালে দিল্লি আইআইটিতে তফসিলি জাতিভুক্ত দুই ছাত্র আত্মহত্যা করেন। সেই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় দিল্লি হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ— নম্বরের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল পড়ুয়াদের মানসিক স্বাস্থ্য।
আদালত জানিয়েছে, আইআইটি কর্তৃপক্ষের উচিত ছাত্রছাত্রীদের বোঝানো যে ভাল নম্বর পাওয়াই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নয়। আরও ভাল নম্বর পাওয়ার চাপের কাছে নতিস্বীকার না করেও তারা জীবনের সেরাটা দিতে পারে। দিল্লি হাই কোর্টের বিচারপতি রজনীশ ভাটনাগরের একক বেঞ্চ ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় জানিয়েছে, ‘‘এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, দুই মেধাবী এবং তরুণ ছাত্রের শিক্ষা জীবন ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতিতে শেষ হয়ে গিয়েছে।’’
বিচারপতি বলেন, ‘‘এমন ঘটনায় মৃতের বাবা-মাকে প্রতিদিন যে চ্যালেঞ্জ এবং যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হয়, তা কেউ বুঝতেও পারে না। তবে আদালত মৃতের বাবা-মায়ের অনুভূতি বুঝতে পারে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সেরা হওয়ার জন্য তরুণ মনকে চাপ দেওয়ার ক্রমবর্ধমান প্রবণতাকে আদালত একেবারেই উৎসাহ দেয় না। এই চাপ তাদের দুর্ভাগ্যজনক পদক্ষেপ করার দিকে পরিচালিত করে। এটাই উপযুক্ত সময় যে শিক্ষকদের পাশাপাশি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অন্যান্য কর্মী-সদস্যরা ছাত্রদের পরামর্শ দেওয়া, উৎসাহিত এবং অনুপ্রাণিত করার জন্য সচেতন প্রচেষ্টা চালানোর কাজ শুরু করুন।’’
হাই কোর্ট আরও বলেছে, সবার আগে যে কাজটা করা উচিত, তা হল তরুণ মনকে বোঝানো যে ভাল নম্বর পাওয়া এবং নিজের সেরাটা দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঠিকই, তবে সেটা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নয়। আত্মহত্যা না করে বা ভালো ফল করার চাপের কাছে নতিস্বীকার না করেও ছাত্রছাত্রীরা তাদের সেরাটা দিতে পারে।
বিচারপতি জানিয়েছেন, যে ক্যাম্পাসে তরুণ পড়ুয়ারা বছরের পর বছর কাটায়, সেখানেই তাদের শিক্ষা দেওয়া, তাদের শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মূল্য বোঝানো সবচেয়ে সহজ। তাদের জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার আত্মবিশ্বাস জোগানোর কাজও প্রতিষ্ঠানকেই করতে হবে।
দিল্লি আইআইটিতে তফসিলি জাতিভুক্ত দুই ছাত্রের আত্মহত্যার ঘটনায় পুলিশ এফআইআর নেয়নি বলে অভিযোগ মৃত ছাত্রদের পরিবারের। এফআইআর দায়ের করার আর্জি জানিয়ে এবং প্রতিষ্ঠানে তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে হওয়া ‘জাতিভিত্তিক নৃশংসতা’র নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁরা।
তাঁদের অভিযোগ ছিল, মেধাবী এবং উজ্জ্বল ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও এবং পড়াশোনায় দারুণ ফল করলেও, প্রতিষ্ঠানেরই কিছু শিক্ষক-সদস্যের হাতে জাতিভিত্তিক বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন তাঁরা। তবুও উদাসীনতা দেখিয়ে পুলিশ এফআইআর নথিভুক্ত করছে না বলে অভিযোগ অভিভাবকদের।
যদিও পুলিশের দাবি, মৃত ছাত্রেরা মেধাবী ছিল তা নিয়ে সন্দেহ নেই, তবে আইআইটি ক্যাম্পাসে তারা জাতিগত বৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছিল, সে রকমটাও নয়। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখে এ কথা প্রকাশ্যে আসে যে মৃত ছাত্রেরা একাধিক বিষয়ে ফেল করেছিলেন এবং সম্ভবত সেই কারণেই তাঁরা আত্মহত্যা করেছেন। কারণ তাঁরা আরও ভাল ফল করার চাপ সহ্য করতে পারেননি।
হাই কোর্ট তার পর্যবেক্ষণে জাতিভিত্তিক বৈষম্যের অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে। বিচারপতি জানিয়েছেন, এমন অভিযোগের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মৃত ছাত্রদের মধ্যে কেউ কখনও এ ব্যাপারে আইআইটি দিল্লির তফসিলি জাতি কিংবা তফসিলি উপজাতি সেল বা পুলিশের কাছে কোনও অভিযোগ জানাননি। এমনকি, ক্যাম্পাসে তাঁদের কোনও বন্ধুও তাঁদের জাতিভিত্তিক বৈষম্যের সম্মুখীন হওয়ার কথা জানাননি বলে জানিয়েছেন বিচারপতি।
মৃত দুই পড়ুয়ার অভিভাবকদের আবেদন খারিজ করে দিয়ে উচ্চ আদালত জানিয়েছে, তারা চরম পদক্ষেপ করা ওই দুই তরুণ ছাত্রের শোকার্ত পিতা-মাতার দুর্দশা এবং তাঁদের যন্ত্রণা সম্পর্কে সচেতন হলেও নিছক অনুভূতি বা সহানুভূতির ভিত্তিতে কোনও নির্দেশ জারি করতে পারে না।