বিদেশ ভ্রমণে সীমারোপ: আইনগত পরিসীমা

বিদেশ ভ্রমণে সীমারোপ: আইনগত পরিসীমা

মোঃ জিয়াউর রহমান: মিঃ ক বিদেশ যাবেন। তিনি এয়ারপোর্টে ঢুকলেন, চেকইন করলেন, বোর্ডিং পাস নিলেন, তারপর ইমিগ্রেশন ক্রস করার সময় পুলিশ তার পাসপোর্ট নিয়ে তাকে অপেক্ষায় রাখলেন। ঘন্টা খানেক পর ইমিগ্রেশন পুলিশ জানালো, আপনি বিদেশ যেতে পারবেন না, আপনার ট্রাভেল রেসট্রিকসন বা এমবারগো আছে। মিঃ ক এর তো আকাশ ভেঙে পড়া অবস্থা। এত টাকা দিয়ে তিনি এয়ারটিকেট কেটেছেন, আত্মীয়রা এয়ারপোর্টে এসে বিদায় জানিয়েছে, কত দিনের প্রস্তুতি আর শেষ মুহুর্তে তিনি জানছেন তার বিদেশ যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা (Travel restriction/embargo) আছে! ক এর বিরুদ্ধে কোন মামলাও নেই। এখন মিঃ ক কী করবেন!

ক এর ঘটনা কাল্পনিক নয়, সত্য (রিট ৫৯৭৬/২০২৩)। এমন ঘটনা কোর্ট অঙ্গনে অপরিচিত বিষয় নয়। কিছুক্ষেত্রে কোর্ট জামিনের শর্ত হিসেবে পাসপোর্ট আটকে রাখে যা নাগরিকের ভ্রমণ সীমারোপ। আমাদের সংবিধানের আর্টিকেল ৩৬ অনুযায়ী যুক্তিগ্রাহ্য বিধিনিষেধ (Subject to any reasonable restrictions imposed by law in the public interest…) সাপেক্ষে, যে কোন নাগরিক বিনা বাধায় দেশের যে কোন স্থানে যেতে পারবে, বসবাস করতে পারবে, সে স্থান ত্যাগ করতে পারবে এবং দেশ ত্যাগ ও পুনরায় দেশে প্রবেশ করতে পারবে। এই অধিকার নাগরিকের মৌলিক অধিকার, আর এটা লংঘিত হলে সে আইনের আশ্রয় নিতে পারবে।

তবে, প্রয়োজনে তার এই অধিকার সংকুচিত করা যায়। এটা অসীম কোন অধিকার নয়। তাহলে আর্টিকেল ৩৬ এর যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধের (reasonable restrictions) প্রকৃতি কী বা বাউন্ডারি কতটুকু হবে? কখন, কিভাবে কারও দেশ ত্যাগে বিধিনিষেধ আরোপ করা যেতে পারে?

এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন আইন বা বিধি নেই। ক্রিমিনাল ল এর cardinal principle হলো, অপরাধ প্রমান না হওয়া পর্যন্ত আসামীকে নির্দোষ ভাবতে হবে। অর্থাৎ অভিযোগ থাকলেই হবে না, সাক্ষ্য প্রমাণে আদালতে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী গণ্য করার সুযোগ নেই। তাহলে স্পষ্ট যে অভিযুক্ত বা আসামি আর অপরাধী এক বিষয় নয়। আর আসামী যদি বিচার এড়িয়ে শুরু হতে বা জামিন নিয়ে পলাতক হয়, তার অনুপস্থিতিতে বিচার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার জন্য CrPC এর ৩৩৯বি এর বিধান সুস্পষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত। বিদেশে গেলে আর ফিরার সম্ভাবনা নেই- শুধু মাত্র এমন ধারণা (apprehension) ভিত্তিতে সীমারোপ অবৈধ হবে যদি না যুক্তিগ্রাহ্য ও উপযুক্ত (reasonable & cogent) কারণ না দর্শানো হয় [2 BLC(AD)157]।

আমাদের সংবিধানের আর্টিক্যাল ৩৬ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সেখানে ট্রাভেল রেস্ট্রিকটেড করতে হলে ৩ টি শর্ত পূরণ করতে হয়ঃ ১) আইনের আওতায় এমন সীমারোপ (restriction) দিতে হবে; এটা হতে হবে যুক্তিসঙ্গত (reasonable), ৩) এটা হতে হবে জনস্বার্থে (public interest)। তাহলে সংবিধান বলছে, আইনের আওতায় এমন সীমারোপ (restriction) দিতে হবে কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন আইন, বিধি বা নীতিমালা আমাদের নেই। তাই বলে কী ট্রাভেল রেস্ট্রিকশন বন্ধ ছিল! না, এর প্রয়োগের বেশ ভাল নজীর আছে। আর নাগরিকেরা মৌলিক অধিকার লংঘনের অভিযোগে উচ্চ আদালতে প্রতিকার চাইতে গিয়েছে এবং দেশে কেস ল ভিত্তিক আইন (precedent/judgement law) তৈরী হয়ে গিয়েছে।

দুর্নীতির মামলার তদন্ত চলাকালে একজনকে ACC ট্রাভেল রেসট্রিকসন দিলে তিনি মাননীয় হাইকোর্টে যান [ Ataur Rahman Vs Gov. Of Bangladesh, Writ Petition 418/2021 ]। এ মাননীয় হাইকোর্ট বলছেন, ২টি শর্ত পূর্ণ করতে হবে, ১) আইনের আওতায় আরোপ করতে হবে, ২) জনস্বার্থে হতে হবে, দুটোর কোন একটা অনুপস্থিত থাকলে এমন সীমারোপ অসাংবিধানিক (unconstitutional)। যেহেতু কোন সুনির্দিষ্ট আইন নাই, তাই সে শূন্যতা পূরণে এ মামলায় মাননীয় হাইকোর্ট অন্তবর্তী গাইড লাইন দিয়েছে। ১) যারা মামলা তদন্ত করছে সে সংস্থা কোর্টে আবেদন করবে, ২) আবেদনটি মঞ্জুর করলে কোর্ট সর্বোচ্চ ৬০ দিনের জন্য এমন নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে, ৩) ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি (Aggrieved party) সে রেস্ট্রিকশন বাতিল বা তুলে নিতে সংশ্লিষ্ট আদালতে দরখাস্ত দিলে শুনানি করে কোর্ট তার আগের আদেশ বাতিল বা তুলে নিতে পারে বা প্রয়োজনীয় আদেশ দিতে পারে, ৪) সীমারোপ বাড়ানোর দরখাস্তের ক্ষেত্রে কোর্ট একইভাবে দুপক্ষকে শুনানির সুযোগ দিয়ে প্রয়োজনীয় আদেশ দিতে পারবে।

এই মামলা সহ মাননীয় হাইকোর্টের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে বেশকিছু Leave to Appeal হয় [CP1340/2021, 1184, 1009/2021, 605/2020, 1523/2021]। সেখানে আমাদের মাননীয় এপেক্স কোর্ট মাননীয় হাইকোর্টের আদেশ পরিমার্জন করে বলছেন, যদি বিচার এড়াতে দেশ ত্যাগ করতে উদ্যত হয় এবং দ্রুত সীমারোপ জরুরি হয়, তাহলে কোর্টের আদেশ ছাড়াই রেস্ট্রিকশন দেওয়া যেতে পারে, তবে তিন কার্যদিবসের মধ্যে তা কোর্ট কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে।

মাননীয় আপীল বিভাগ এ মামলায় [74 DLR(AD)1] বিষয়টি নিয়ে মোট ৮ পয়েন্ট এ চমৎকার নীতি/গাইডলাইন করে দিয়েছেন। আর আপীল বিভাগের এই নজীর (Precedent) ই আইন (Article ১১১)। এই অনুসরণ না করা মানে আপীল বিভাগের আদেশ আমান্য করা যার জন্য আদালত অবমাননার জন্য দোষী ব্যক্তি শাস্তি পেতে পারে। চলুন দেখি মাননীয় আপীল বিভাগ কিভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করছেন এবং সমাধান দিচ্ছেনঃ
১. সংবিধানের ৩৬ এর অধিকার চূড়ান্ত অধিকার (absolute right) নয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে এই অধিকার সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে।
২. আর্টিক্যাল ৩৬ এর আওতায় কোন রেস্ট্রিকশন আরোপ করতে হলে তা হতে হবে প্রণীত আইনের অধীনে এবং তা যুক্তিসঙ্গত ভাবে জনস্বার্থে (public interest) হতে হবে।
৩. আইনগত সমর্থন ছাড়া শুধুমাত্র এক্সিকিউটিভ আদেশে নাগরিকের স্বাধীন চলাচলে সীমারোপ অসাংবিধানিক।
৪. আইনপ্রণেতাদের যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধের (reasonable restrictions) দৃষ্টিভঙ্গি চূড়ান্ত ও একচ্ছত্র হবে না এবং তা আদালতের সুপারভিশনের মধ্যে থাকবে।
৫. এমন যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ স্বেচ্ছাচারী (Arbitary) হবে না, এবং জনস্বার্থের (Interest of public) বাইরে হবে না। একটা নির্ধারিত মেয়াদ বা উদ্দেশ্য সাধনে সম্ভাব্য সময়কালের জন্য হবে।
৬. এই অধিকার কে Absulate করলে সুচারু ভাবে সমাজ চলবে না। যুক্তিগ্রাহ্যতা ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া উচিত।
৭. কারও বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল মামলা থাকলেই তার এই মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া যাবে না। যদি ক্রিমিনাল অপরাধে অভিযুক্ত (Charged) ব্যক্তির উপস্থিতি দরকার হয়, তখন দেশের বাইরে যাওয়া এবং পাসপোর্ট রাখার অধিকার সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে।
৮. যারা আইনের হাত হতে বাঁচতে দ্রুত দেশ ত্যাগ করতে চায়, তাদের উপর ভ্রমণ সীমারোপ করা যেতে পারে (may be imposed) তবে তা হবে হবে, উপযুক্ত আদালতের অনুমোদন সাপেক্ষে (subject to confirmation of appropriate court), ৩ (তিন) কার্যদিবসের মধ্যে।

মাননীয় এপেক্স কোর্টের এই রায় [74 DLR(AD)1] সহ অন্যান্য নজীরের মধ্যে দিয়ে আইনগত ভাবে এটা প্রতিষ্ঠিত, উপযুক্ত আদালতের অনুমোদন ছাড়া নাগরিকের ভ্রমণ অধিকার ক্ষুন্ন বা সীমাবদ্ধ করার ক্ষমতা অন্য কোন কর্তৃপক্ষের নেই। যদি সীমারোপ করতে হয়, তা অনির্দিষ্ট কালের জন্য হবে না (not for an indefinite period of time), আরোপের পূর্বে নাচারাল জাস্টিস নর্মগুলো মেনে অন্য পক্ষকে শুনানির সুযোগ দিতে হবে, এমন সীমারোপ Arbitrary হবে না, হলে তা অবশ্যই জনস্বার্থে হতে হবে।

রেফারেন্স:
১. রিট ৫৯৭৬/২০২৩
২. 74 DLR(AD)1
৩. রিট ৪১৮/২০২১
৪. 2 BLC(AD)157
৫. The Code of Criminal Procedure
৬. The Constitution of Bangladesh
৭. Travel ban may be imposed in reasonable cases: SC, Daily NEWAGE report on December 1, 2021
৮. Travel ban on the accused: the current legal regime in Bangladesh, Shah Maruf

লেখক: বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) সাইবার ট্রাইব্যুনাল, রাজশাহী। ই-মেইল: judgezia@gmail.com