ড. কামরুল হাসান হীরা: প্রেম-ভালোবাসা স্বর্গীয় এবং ইহার পূর্ণতা পায় বিয়ের মধ্যে দিয়ে। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যেখানে স্বামী, স্ত্রী ও সৃষ্টিকর্তার মধ্যে রয়েছে এক ত্রিমাত্রিক পবিত্র ও বিশুদ্ধ সম্পর্ক। বিবাহিত জীবন মানে নিজেদের শত মান-অভিমান, দুঃখ-যন্ত্রণা, বিরহ-ব্যাথা এবং সাময়িক সুখে ভরা এক গুপ্ত আরাধনা।
স্বামী-স্ত্রীর বিবাহিত জীবনের মূল ভিত্তি হল বিশ্বস্ততা। যা কিনা প্রেম, ভালোবাসা, বিশ্বাস, আবেগ, অনুভতি, দায়িত্ব ও কর্তব্যের এক জটিল সমীকরণ । গবেষণার ফলস্বরূপ বলা যায় বিশ্বস্ততার প্রধান শত্রু হলো সন্দেহ প্রবণতা। সন্দেহ প্রবণতার পূর্বলক্ষণ নিঃসঙ্গতা এবং নিঃসঙ্গতা থেকে জন্ম নেয় একাকীত্বতার। পৃথিবীর কোন মানুষই নিঃসঙ্গ বা একা থাকতে চায় না। বৈবাহিক জীবনে বৈরী সম্পর্ক বা পরিস্থিতি হলেই স্বামী বা স্ত্রী খুঁজে নেন নিঃসঙ্গ বা একাকীত্ব জীবনের বাঁকা পথ। যে পথ কখনোই মসৃন নয়। যে পথে রয়েছে ধর্মীয়, সামাজিক ও আইনী জঠিলতা।
এবার আসা যাক মূল আলোচনায়। বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে স্বামী-স্ত্রীকে নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক অধিকার আদায় বা পালনে অবহেলা, উশৃংখল জীবন যাপন, রাগ-অভিমান, মনের অমিল, বনিবনা না হওয়া ইত্যাদি সহ ছোটখাটো বিষয় নিয়ে নানা প্রকার সমস্যার সৃষ্টি হয়। একটা সময়ে উল্লেখিত সমস্যা গুলো জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে এবং পরবর্তীতে তালাক বা বিবাহ-বিচ্ছেদে রূপ নেয়। এভাবেই স্বামী ও স্ত্রীর মধুর সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটে।
তালাক শব্দটি আরবী শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়া বা ত্যাগ করা। ইসলাম ধর্মে তালাক বলতে স্বামী ও স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক হইতে বিচ্ছিন্ন হওয়াকে বুঝায়। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করা একটি জঘন্য বা গর্হিত বা ঘৃণিত কাজ। একজন মুসলিম স্বামী তার স্ত্রীকে যেকোন সময় তালাক দিতে পারেন । কিন্তু ঐ স্ত্রী চাইলেই তার স্বামীকে তালাক দিতে পারেন না। তবে স্ত্রী কর্তৃক তার স্বামীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা শর্তযুক্ত বটে।
ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে তালাক বিভিন্ন পদ্ধতিতে কার্যকর করা যায়। যেমনঃ
(১) তালাক আহসান- স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে এক বার এক তালাক দেওয়া;
(২) তালাক হাসান- স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তিন মাসে তিন বার তালাক দেওয়া;
(৩) তালাক-উল-বিদাত বা তালাক-ই-বাদাই – স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে একসাথে তিন বার তালাক সহ বাইন তালাক দেওয়া;
(৪) তালাক-ই-তাওফিজ – স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা;
(৫) খুলা- স্ত্রীর পক্ষ হইতে প্রস্তাব এবং দুই পক্ষের সম্মতিতে তালাক দেওয়া;
(৬) মুবারত- স্বামী ও স্ত্রী চুক্তির মাধ্যমে তালাক দেওয়া;
(৭) ইলা- স্বামী তার স্ত্রীর সহিত প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে তালাক দেওয়া;
(৮) লিয়ান- স্ত্রী কর্তৃক তালাকের মোকদ্দমা;
(৯) জিহার- বিবাহ নিষিদ্ধ শ্রেণীভুক্তের সহিত তুলনা করলে সাময়িক তালাক হয়।
ধর্মীয় দৃষ্টিতে একজন ঋতুবতী স্ত্রী তার স্বামী হইতে তালাকপ্রাপ্ত হওয়ার পর ৩ (তিন) ঋতু কাল বা ইদ্দত কালীন সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। উক্ত ইদ্দত কালীন সময় শেষ হলেই তালাক কার্যকর হয়। আমাদের সমাজে প্রকাশ্যে কিংবা পালিয়ে বিবাহ করাটা যতটা সহজ সেখানে তালাক প্রক্রিয়া তার চেয়েও জটিল। একবার তালাক হয়ে গেলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নানা প্রকারের অনুশোচনা তৈরি হয়। সমাজে আজকাল তালাকের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। তার পিছনে অনেক কারণ লক্ষ্য করা যায়।
বৈবাহিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হলেই শুরু হয় জুলুম, নির্যাতন এবং ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি। যার ফলে দাম্পত্য সম্পর্কে তৈরি হয় নানা জটিলতা। একটা সময় মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়। একইসাথে বাবা মায়ের মধ্যে তালাক হলে সন্তানদের আজীবন প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়।
আমাদের সমাজের মানুষ এ বিষয় গুলো ভিন্ন ভাবে দেখেন। তালাক শুধু কাগজ-কলমে লিখিত হলেই হয় না। তালাক তালাক প্রক্রিয়ায় নানা প্রকার বিধিনিষেধ রয়েছে। বাবা মায়ের তালাক বা বিবাহ-বিচ্ছেদের সাথে সন্তানদের ভবিষ্যত, ধর্মীয় নিয়ম কানুন ও আইনি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় এক রুশ ভদ্রমহিলা ছদ্মনাম ‘ক’ যিনি অর্থোডক্স খ্রিস্টান ও বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও ঘটনাক্রমে এক মুসলিম ভদ্রলোক ছদ্মনাম ‘খ’ এর সাথে প্রথমে সাক্ষাৎ, কথোপকথন, প্রেম এবং পরে গভীর সম্পর্কে জড়ান। উক্ত সম্পর্ক চলাকালীন সময় ‘খ’ নামক ব্যক্তি তার নিজ দেশে চলে আসেন। সুদূর প্রবাসে রেখে আসেন প্রেমিকার সহিত আবেগ জড়ানো স্মৃতি।
একটা সময় ‘ক’ চিঠির মাধ্যমে জানান যে তিনি ‘খ’ এর সাথে দেখা করতে আসতে চান। চিঠির জবাবে ‘খ’ তার মৌন সম্মতি জানান। এরপর ‘ক’ চলে আসেন ‘খ’ এর কাছে। ঘটনা প্রবাহে ‘ক’ নিজ স্বামীকে ধর্মান্তরিত হতে অনুরোধ জানান, কিন্তু স্বামী ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকার করেন।
ধর্মান্তরিত হতে স্বামী অস্বীকার করায় স্বামীকে তালাক দেওয়ার জন্য আদালতে মামলা করেন। এরপর ‘ক’ ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং ‘খ’ কে বিয়ে করেন এবং বিবাহিত জীবনে তাদের একটি সন্তান জন্ম নেয়। অন্যদিকে, ‘ক’ এর তালাকের মামলা আদালতে চলমান।
উক্ত তালাক, ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ, বিবাহ এবং প্রচলিত আইনি জঠিলতা গিয়ে পৌঁছায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতে এবং উচ্চ আদালতের রায়ে ‘ক’ তালাকের মামলায় হেরে যান। কেননা ধর্ম সার্বজনীন। কখনো কখনো ধর্মীয় স্বাধীনতা ধর্মীয় বিধিনিষেধের কাছে পরাস্ত হয়।
আবার ধর্মীয় বিধিনিষেধ ও মানবিক সম্পর্কের কাছে একটি দেশের আইনকেও পরাস্ত হতে হয়। তাই বলা যায় কিছু তালাক প্রক্রিয়ায় আইন ও ধর্মীয় বিধিনিষেধ বড় ধরণের জঠিলতার সৃষ্টি হয় এবং যা সমাধান করা অসম্ভহব হয়ে পরে।
সরকার চাইলে দেশের সর্বত্র ওয়ার্ড ভিত্তিক বাধ্যতামূলক বিবাহপূর্ব কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। যার ফলে বিয়ের বিষয় নিয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েরা নিজেদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা বা বিবাহিত জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক বজায় রাখাবে বা দাম্পত্য সম্পর্ক উন্নত করতে সাহায্য করবে। যার ফলে সমাজে তালাক প্রবণতায় বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।