শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: ব্রিটিশ আমলে কাজী নজরুলের কিছু গ্রন্থ রাজনৈতিক কারণে বাজেয়াপ্ত করা হয়। গ্রন্থ ছাড়াও কাজী নজরুলের জ্বালাময়ী লেখা প্রকাশের জন্য ১৯২০ সালের মাঝামাঝির দিকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগে’র জামানত কেড়ে নেওয়া, ‘ব্যথার দান’—এ প্রকাশিত গ্রন্থে ‘লাল ফৌজ’ কথাটি সেন্সর করাসহ ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার দুটি সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ শীর্ষক কবিতা লেখা ও প্রকাশ এবং এগারো বছরের মেয়ে শ্রীলীলা মিত্রের ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ৎ’ প্রকাশ করার জন্য কাজী নজরুলকে আসামি করে ব্রিটিশ রাজ সরকার সমকালীন ‘ইন্ডিয়ান পেনাল কোড, ১৮৬০’ এর ১২৪ক ধারায় ‘ধূমকেতু রাষ্ট্রদ্রোহ’ নামে একটি মামলা করেছিল। মামলারটির ফরিয়াদি ছিল ব্রিটিশ রাজ সরকার। এ কারণে ইতিহাসে এ মামলা THE EMPEROR VS KAZI NAZRUL ISLAM AND OTHERS নামে পরিচিত। এ মামলায় কাজী নজরুলের এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল।
উল্লেখ্য, বাঙালি সৈনিক হিসেবে কাজী নজরুল করাচীর সেনানিবাসে অবস্থান কাল থেকেই ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দাবাহিনী তাঁকে সন্দেহ চোখে দেখে এসেছিল। তিনি সেনানিবাসে থাকা কালে রুশ বিপ্লবের খোজ খবর রাখতেন এবং এ বিপ্লবের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। সেই সময়ে তাঁর রচিত গল্পোপন্যাস ‘ব্যথার দান’ এবং ছোটগল্প ‘হেনা’—তে রুশ বিপ্লবের প্রভাব লক্ষণীয়।
সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ (১৯২০) পত্রিকায় কর্মরত কালে কাজী নজরুলের সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলো পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গণমানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই প্রবন্ধসমূহে তিনি রুশ বিপ্লব, আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রাম, সামন্ততান্ত্রিক শৃঙ্খলমুক্ত নতুন তুরস্ক এবং পরাধীন ভারতের মুকিতর সংগ্রামকে এক সূত্রে গ্রথিত করেছিলেন। ফলে অসহযোগ আন্দোলন ও খিলাফত আন্দোলন বিপুল গতি সঞ্চার করেছিল। নবযুগে প্রকাশিত কাজী নজরুলের সম্পাদকীয় প্রবন্ধের কারণে পত্রিকা ডিক্লারেশনের জন্য জমা করা এক হাজার টাকা ব্রিটিশ ভারত সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল এবং কাজী নজরুলকে সতর্ক করা হয়। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ তাঁর লেখালেখি বিষয়ে ফাইল খোলে গোয়েন্দা নজরদারি করত। বিপ্লবীদের মুখপত্র ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে কাজী নজরুল ইংরেজ শক্তির মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করলেন। ‘ধূমকেতু’ সমন্ধে সমকালীন IB—এর ছিল— (Dhamketu) “Started from 11th August, 1922. Preaches emancipation from all restrains-Political, Social or religions, Independent in tone.”
ব্রিটিশ ভারত সরকারের বাংলা সরকার কাজী নজরুলের প্রকাশিত লেখা—গ্রন্থাবলিতে রাজদ্রোহমূলক নিদর্শন অনুসন্ধান করতেন। ১৯২০ সালে ‘নবযুগ’ কাজ করার সময় থেকেই কাজী নজরুলকে বাজেয়াপ্তির শাস্তি ভোগ করতে হয়। এই বাজেয়াপ্তির নেপথ্যে কাজী নজরুলের ব্রিটিশ বিরোধিতা হচ্ছে অন্যতম। কাজী নজরুলের প্রথম যে বইটি নিষিদ্ধ হয় তার নাম ‘যুগবাণী’ (১৯২২)। এ গ্রন্থটি প্রবন্ধের সংকলন যা ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ পত্রিকায় লিখিত সম্পাদকীয় নিবন্ধসমূহ। এটি ১৯২২ সালের অক্টোবরে গ্রন্থাগারে প্রকাশিত হয়। ঐ বছরই ২৩শে নভেম্বর বইটি ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ (১৮৯৮ সালের ৫নং আইন)—এর ৯৯ এ ধারা অনুসারে গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারত সরকারের বাংলা সরকার বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। ১৯৪৭ সালের ৩১শে মার্চ গ্রন্থটির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পূর্বে পর্যন্ত তা বহাল ছিল।
এ সম্পর্কে বাংলা সরকারের কতৃর্পক্ষে নিম্নে উল্লিখিত মন্তব্য মাধ্যমে গ্রন্থটি সম্বন্ধে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মন্তব্যটির অংশ বিশেষ হচ্ছে :
I have examined the book `Yugabani’. It breathes bitter racial hatred directed mainly against the British Preaches revolt against the existing administration in the country and abuses in the very strong language the `Slave-minded’ Indians who up holds the administration. The three articles on `Memorial to Dyer’, `Who was responsible for the Muslims massacre? and `shooting the black men’ are especially objectionable. I don’t think it would be advisable to remove the ban on this book in the present crisis. On the whole it is a dangerous book, forceful and vindictive. [Sd/- illegible, date : 16.1.41, File No 54-31/40 Home (Pol)]
[উদ্ধৃতি : নিষিদ্ধ নজরুল : শিশির কর। আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি., কলকাতা, ১৯৮৩। পৃ. ১০—১১।]
উপযুর্ক্ত মন্তব্য থেকেই ‘যুগবাণী’ গ্রন্থটি বাজেয়াপ্তের তথ্য পাওয়া যায়। ‘যুগবাণী’ বই বাজেয়াপ্তের প্রায় ২০ বছর পরও উক্ত গ্রন্থটি সম্পর্কে সরকারিমহলে কত উদ্বেগ।
উল্লেখ্য, ‘যুগবাণী’ গ্রন্থটিতে তিনটি আপত্তিকর নিবন্ধের জন্য ব্রিটিশ ভারতের বাংলা সরকার এ গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করে। এ নিবন্ধগুলো হলো- (১) ডায়ারের স্মৃতিস্তম্ভ, (২) মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ীকে এবং (৩) কালা আদমীকে গুলি মারা। উক্ত প্রবন্ধগুলোর জন্য ‘নবযুগ’ পত্রিকারও জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
‘যুগবাণী’ গ্রন্থের বাজেয়াপ্তের এক বছর পরই ১৯২৪ সালে কাজী নজরুলের দুটি কবিতার বই বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। এই বই দুটি হলো ‘বিষের বাঁশি’ ও ‘ভাঙার গান’। দুটি বইই ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ (১৮৯৮ সালের ৫নং আইন)—এর ৯৯এ ধারা অনুসারে বাজেয়াপ্ত হয়।
কাজী নজরুলের ‘বিষের বাঁশি’ দেশদ্রোহাত্মকভাবের কবিতা সংকলন। এ গ্রন্থটিও ১৯২৪ সালের ২২শে অক্টোবর ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮—এর ৯৯এ ও ১২৪এ ধারা অনুযায়ী গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত করা হয়। তবে বাংলা সরকার ১৯৪৫ সালের ২৭শে এপ্রিল ‘বিষের বাঁশি’ থেকে বাজেয়াপ্তের আদেশ প্রত্যাহার করে।
পরবর্তীতে কাজী নজরুলের ‘ভাঙার গান’ আগস্ট ১৯২৪ কাব্যগ্রন্থের ওপর খড়গ নেমে আসে। ‘ভাঙার গান’ গ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে আগুনের ফুলকির মতো। এ গ্রন্থের অন্তভুর্ক্ত একটি বিখ্যাত গান ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট’ গানটি। ‘ভাঙার গান’ বইটি ১৯২৪ সালের ১১ নভেম্বর বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং ১৯৪৭ সালের আগে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি। এ গ্রন্থটি ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮—এর ৯৯এ ধারা বলে নিষিদ্ধ করা হয়।
অতঃপর কাজী নজরুল ইসলামের যে কাব্যগ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত হয় সেটি হলো ‘প্রলয় শিখা’ (১৯৩০)। এ গ্রন্থটি ফৌজদারি দণ্ডবিধি, ১৮৬০—এর ১২৪এ ও ১৫৩ এ ধারানুসারে ১৯৩০ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি এ গ্রন্থটির ওপর থেকে বাজেয়াপ্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
‘প্রলয় শিখা’র পর কাজী নজরুলের বাজেয়াপ্ত গ্রন্থ ‘চন্দ্রবিন্দু’। এ গ্রন্থটি সেপ্টেম্বর ১৯৩১ সালে প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত হয়। জানা যায়, ১৯৩১ সালের ১৪ই অক্টোবর ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮—এর ৯৯এ ধারানুসারে গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
ব্রিটিশ আমলে কাজী নজরুলের উপযুর্ক্ত ৫টি গ্রন্থ বেশকটি কারণে ব্রিটিশভারত সরকারের বাংলা সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত করে। এগুলো হলো ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অনুপ্রেরণা, বিদ্রোহের বাণী প্রচার, ভাঙ্গনের বীজ বপন, অসন্তোষ উৎপাদনসহ ইংরেজদের বিদ্রুপের তীক্ষè শরাঘাত করা প্রভৃতি।
বস্তুত কাজী নজরুলের গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করেও তা মুদ্রণ ও বিপ্লবীদের হাতে পৌঁছানো থেকে বিরত রাখা যায়নি। তাঁর এসব গ্রন্থ দৃঢ়ভাবেই যুগের দাবি মিটিয়েছে। তৎক্ষণিক জনচিত্তে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। গ্রন্থের প্রচার আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজী নজরুল সর্ব ভারতীয় নেতাদের মতোই কবি খ্যাতি পেয়েছেন।
লেখক : গবেষক