কাজী শরীফ: কয়েকদিন আগে একজন ভদ্রমহিলা অ্যাফিডেভিট করতে এলেন৷ তার প্রায় ছয় বছর বয়সী কন্যাকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারছেন না। জন্মনিবন্ধনে বাচ্চার মায়ের নাম ভুল এসেছে।
বললাম, শুদ্ধ নাম কোথায় আছে?
জানালেন তার এনআইডি কার্ডে।
জানতে চাইলাম, আপনিই যে ওর মা বুঝব কী করে?
বললেন, আমাদের বিয়ের কাবিননামা আছে।
দেখলাম কাবিননামায় তার নামের সাথে এনআইডি কার্ডের নাম মিল আছে।
অ্যাফিডেভিট করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কী করেন?
বললেন, গার্মেন্টসে চাকুরি করেন।
অ্যাফেডেভিটে স্বাক্ষর করে সিল দেয়ার জন্য সহকারী ইব্রাহিমকে ফর্মটা দিতে দিতে বললাম, মেয়ের বাবা কী করে?
“স্যার হে কাভার্ড ভ্যান চালায়।”
বললাম, আপনি কষ্ট করে এলেন। মেয়ের বাবা এলো না!
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বললেন, স্যার আমার মেয়ে কি স্কুলে ভর্তি হইতে পারব না?
বললাম, অবশ্যই পারবে।
ইব্রাহিম বলল, আপনি পাশের রুমে বসেন। আমি সিল মেরে দিয়ে দিচ্ছি।
ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকিয়ে চোখে জল নিয়ে বললেন, স্যার এ ভুলটার জন্য আমার মাইয়াডারে স্কুলে ভর্তি করাইতে পারতেছে না। মাইয়ার বাপের হেদিকে খেয়াল নাই!
আমি বললাম, আপনি খেয়াল করেছেন তাতেই হয়েছে। এখন ভর্তি করে ফেলেন।
মহিলা এবার বললেন, স্যার মাইয়ার বাপে আমারে তালাক দিছে। দূরে দূরে থাইকা মাইয়ার জন্য আর কত ঘুরতাম কন!
আমি বললাম, তালাক দিল কেন?
“স্যার আমরা প্রেম করে বিয়া করছিলাম৷ হের মায় মানে নাই। পরে এই মাইয়া অইবার পর হেয় আমারে তালাক দিছে!”
আমি বললাম, সংসার টেকাতে চেষ্টা করেন নাই?
“স্যার আমি হে আর হের মা’র ঠেংগে পর্যন্ত ধরছি। হেয় কয় সংসার করব না!”
আমি বললাম, দেখেন সংসারতো যার সংসার তার। জোর করার কিছু নেই। এখন বলেন তো মেয়ে কার কাছে থাকে?
“স্যার আমি হারাদিন থাকি গার্মেন্টসে। বাপ মইরা গেছে। দেহার কেউ নাই। মাইয়ারে দেখব ক্যাডা। বুজেনইতো মাইয়া মানুষ। কোর্টে মাইয়ারে বাপেরে দিয়া দিছে।”
বুঝতে পারলাম পারিবারিক আদালত বাচ্চাকে ওর বাবার কাছে দিয়েছে।
“আমারে জিজ্ঞেস করছিল। আমি কইলাম আমি গার্মেন্টসে থাইকা মাইয়ারে দেখমু ক্যামনে? থাক। দাদির কাছেই থাক। তবুতো আমার মাইয়াডা ভালো থাকব!”
মহিলা ঝরঝর করে কান্না করছিলেন।
ছয় বছরের মেয়েটা মাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
মহিলা বললেন, স্যার আমারে ঠিকমত দেখতেও দেয় না। কোর্ট কইছিল সপ্তাহে একদিন আমারে দেখতে। স্যার জানেন, আমার গার্মেন্টস বন্ধ থাকলে একটা রাইত মাইয়াটারে জড়াই ধইরা ঘুমাইতে মন চায়। হেরা দেয় না!”
এটা বলেই মেয়েটাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বাচ্চাটা কী মিষ্টি! আমার সারাহর আর ওর বয়সও কাছাকাছি!
আমি খুব অল্পতে কেঁদে দিই। এ দৃশ্য দেখে কান্না ধরে রাখতে পারছিলাম না। আমার হেঁচকি ওঠা শুরু হয়েছে!
আমি লক্ষ্য করলাম, ইব্রাহিমের চোখেও পানি।
মেয়ের মা বলতে লাগলেন। আমি কিছুই শুনতে পারছি না। আমার শুধু মেয়েটা ও তার মায়ের জড়িয়ে ধরার দৃশ্যটা চোখে লেগে আছে!
ভদ্রমহিলাকে বললাম, মেয়ের বাবার ফোন নাম্বারটা দেন।
তিনি বললেন, স্যার আপনি কল করবেন! হের ব্যবহার ভালো না!
আমি বললাম, ভালো না হলে না। ওনার যা ইচ্ছা বলুক। আমি কল করবই।
ইব্রাহিম সামনে দাঁড়ানো। আমার রুমের বাইরে অপেক্ষমান লাইন৷ আমি কল করলাম।
দুই তিনবার রিং পরার পর ভদ্রলোক ফোন ধরলেন। অনেকক্ষণ ধরে পরিচয় দেয়ার পর আমি কে বুঝলেন।
বললেন, স্যার আমিতো গাড়ি চালাই।
বললাম, গাড়িটা সাইড করে কথা বলা যায়?
তিনি সম্ভবত গাড়ি একপাশে দাঁড় করালেন। আমি কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আবার মিলে যেতে অনুরোধ করলাম৷
আমার অনুরোধ দেখে ইব্রাহিম বিব্রত হচ্ছিল। ইব্রাহিম তার স্যারকে এভাবে নুয়ে পড়তে দেখেনি!
ভদ্রলোক বললেন, স্যার আমার মায়ের লগে হের গালমন্দ হইছে। দেহি কী করন যায়!
আমি তাকে আবার বুঝিয়ে ফোন রাখলাম। আমার সাথে একবেলা ভাত খেতে দাওয়াত দিলাম।
তিনি দাওয়াত কবুল করবেন বলেছেন।
আমি জানি না তিনি সন্তানের জন্য সংসারটা আবার জোড়া লাগাবেন কি না? জানি না মেয়েটা তার মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে পারবে কি না!
শুধু জানি আমি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ওর মা যেন ঘুমাতে পারে সে চেষ্টা করেছি। রমজানের এ পবিত্র দিনে আল্লাহর কাছে চাই এ সংসারটা আবার জোড়া লেগে যাক। এ মেয়েটা তার মা ও বাবার সাথে একসাথে দিন কাটাক।
আমার চিৎকার করে মা বাবাদের বলতে ইচ্ছা করে, স্বামী স্ত্রীর বিচ্ছেদ হলেও মা বাবার কখনোই বিচ্ছেদ করা উচিত নয়।
লেখক: মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, চট্টগ্রাম।