চন্দন কান্তি নাথ: বিচার ব্যবস্থার মধ্যে ফৌজদারি মামলার পাশাপাশি দেওয়ানী মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কেননা অধিকাংশ ফৌজদারি মামলার ভিত্তি দেওয়ানী মামলা হয়। শোষন মুক্ত সমাজ তান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা মৌলিক মানবাধিকার রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করার জন্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান রচনা করেন।
কিন্তু আদালত গুলোতে ৪০,০০০০ (চল্লিশ লক্ষ) মামলা বিচারাধীন রয়েছে। দ্রুত বিচার না হওয়ার কারণে মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্গিত হচ্ছে। মানুষ অনেকটা সময় আদালতে কাটাচ্ছে এবং সুবিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফৌজদারী মামলাতে দেরি হয়। তবে দেওয়ানী মামলা কতদিনে’ শেষ হয় সে সম্পর্কে কিছু না বলাই ভালো।
২৫ শে জানুয়ারী ১৯৭৫ সনে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলেন………. যদি একটা মামলা সিভিল কোর্টে হয়, ২০ বছরে সে মামলা শেষ হয় বলতে পারেন আমার কাছে…. তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ‘…..সিস্টেমের মধ্যে পরিবর্তন করতে হবে। মানুষ যাতে বিচার পায় এবং সাথে সাথে বিচার পায়। ‘ব্যাপক পরিবর্তন দরকার।’
বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সনে সকল দেওয়ানী মামলা বিকল্প পদ্ধতিতে নিষ্পত্তির জন্যে আইনে প্রথম বার সংশোধন আনেন। পরবর্তীতে সকল দেওয়ানী মামলা বিকল্প পদ্ধপতিতে নিষ্পত্তির জন্যে ২০১৬ সনে বাধ্যতা মূলক বিধান প্রনয়ন করেন। কিন্তু বাস্তবে বিজ্ঞ আইনজীবী এবং বিচারকগণের পারস্পরিক আন্তরিকতার অভাবে ও তদারকির ঘাটতির কারণে আইন আদালতে তা কার্যকর হচ্ছে না।
আবার দেওয়ানী মামলায় সমনজারির পর সঠিক ভাবে জবাব প্রদান করলেই দ্রুত দেওয়ানী মামলা নিষ্পত্তি হয়। আবার যে আদালতে মামলা হয় তার নাম, বাদীর নাম, পরিচিতি এবং বাসস্থান (যতদূর তা নির্ধারণ করা যেতে পারে), যে ক্ষেত্রে বাদী অথবা বিবাদী নাবালক কিংবা বিকৃত মস্তিষ্কর হয় সে মর্মে বিবৃতি, মামলার কারণ সৃজনকারি ঘটনা বলি এবং তা যখন উদ্ভব হয়, আদালতের এখতিয়ার আছে দেখিয়ে ঘটনাবলি এবং বাদী দাবী করে এরূপ প্রতিকার, যে ক্ষেত্রে বাদী তার দাবীর একাংশ পরিত্যাগ করেছে, সে অংশের পরিমাণ, মামলা অনুযায়ী এখতিয়ার এবং কোর্ট ফি নির্ণয়ার্থে মামলার বিষয় বস্তু সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়সহ উল্লেখে দেওয়ানী মামলা দায়ের করা হয়।
বিবাদী হাজির হয়ে জবাব দাখিল করেন। সে সময় তার বক্তব্যের সমর্থনে যে সমস্ত দলিলাদি থাকে তা আদালতে দাখিল করতে হয়। যে সমস্ত দলিলাদি তার নিকট থাকে না সেগুলো কার নিকট আছে তাও বর্ণনা করতে হয়। সমস্ত দলিলের একটি ফিরিস্তি দিতে হয়। তাছাড়া শুনানীর সময় আদালতের অনুমতি ব্যতীত অন্যে কোন দলিল দাখিল করা যায় না। জবাবে মামলাটি চলে কিনা কিংবা বাদীর সাথে লেনদেন আইনে প্রশ্নের বাতিল বা বাতিল যোগ্য কিনা ইত্যাদি বিষয়ে উল্লেখ করতে হয়।
তাছাড়া তঞ্চকতা, তামাদি, সম্পাদন, পরিশোধ, বে—আইনী ঘটনা বলি ইত্যাদি উত্তাপন করতে হয়। বিবাদীর তার লিখিত বর্ণনায় বাদীর অভিযোগের কারণ গুলো সাধারণ ভাবে অস্বীকার করলে হয় না। এটি পর্যাপ্ত হয় না। বিবাদী কে অবশ্যই প্রতিটি অভিযোগের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে হয় এবং যেটির সত্যতা বাদী স্বীকার করে না, তা অবশ্যই স্পষ্ট করে বলতে হবে। শুধু মাত্র ক্ষতির অভিযোগের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রয়েছে।
বিবাদী আরজী বর্ণিত একটি বিষয় সম্পর্কে অস্বীকার করতেই পারে। তবে তা অসৎ ভাবে কিংবা ঘুরিয়ে পেচিয়ে কিংবা আকাঁবাকা ভাবে কিংবা অস্পষ্ট বাক্যে অস্বীকার করলে হবে না। বরং সুনির্দিষ্ট ভাবে সোজাসুজি স্পষ্ট বাক্যে উক্ত বিষয়ের উত্তর দিতে হবে। ছলনাপূর্ণ বা অস্পষ্ট অস্বীকৃতি আদৌ অস্বীকৃতি নয়। সুনির্দিষ্ট ভাবে এবং প্রয়োজনীয় বর্ণনা সহ অস্বীকৃতি না হলে অথবা বিবাদী কতৃর্ক স্বীকৃত নয় বলে পরিষ্কার ভাবে বর্ণনা করা না হলে তবে উক্ত বিষয় জবাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে ধরা হয়। যে বিষয় সম্পর্কে বিবাদীর জ্ঞান নাই, জবাবে অস্বীকৃতি হয় নাই, তা বিবাদী কতৃর্ক স্বীকৃতি বলে ধরা হয়। তবে ডিজেবল ব্যক্তির ক্ষেত্রেই উক্ত বিধান প্রযোজ্য হয় না।
কিন্তু টাকা আদায়ের মামলার ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। দেওয়ানী কার্যবিধির আদেশ ৯ ছাড়াও পরিশিষ্ট—ক তে জবাবের নমুনা দেয়া আছে। সে অনুসারে বিবাদী যে তথ্য অস্বীকার করে তা বর্ণনা করতে হবে এবং বিবাদী যে তথ্য স্বীকার করে না তারও বর্ণনা করতে হবে। আর বিবাদী যে বিষয় স্বীকার করে তার ধারাবাহিক বর্ণনা করতে হয়। বিবাদীর কোন প্রতিবাদ থাকলে কিংবা মামলায় তামাদি সংক্রান্ত বিষয়ে কিংবা এখতিয়ার সংক্রান্ত, দেউলিয়াত্ব, নাবালকত্ব, আদালতে টাকা জমা দেওয়া সংক্রান্ত, সম্পাদন হইতে রেহাই সংক্রান্ত, চুক্তি বাতিল, রেজ জুডিকাটা, ষ্টপেল ইত্যাদি উল্লেখে বিবাদীর বক্তব্যে উপস্থাপন করতে হয়।
বিবাদী সুনির্দিষ্ট ভাবে বাদীর কোন বক্তব্যে অস্বীকার না করলে তা শুধু স্বীকৃতি হিসাবে গন্য হয় না, আইনত বাদীর তা প্রমান করা লাগে না। ১৮ ডিএল আর পৃষ্ঠা ১৯৮, ১৯ ডিএল আর পৃষ্ঠা ৯০৫, ৫০ ডিএল আর পৃষ্ঠা ১৮৬, ৩৬ ডিএল আর পৃষ্ঠা ৮১, ১৮ বিএল ডি পৃষ্ঠা ২১, ২০ বিএল সি পৃষ্ঠা ৬৪, ৩ এম এল আর পৃষ্ঠা ১৮, ৩ বি সি আর পৃষ্ঠা ২২৫ মামলাতে ছলনাপূর্ণ অস্বীকৃতিকে স্বীকৃতি হিসাবে গন্যে করা হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে ছলনাপূর্ণ অস্বীকৃতি আইনের চোখে কোন অস্বীকৃতিই না বরং তা স্বীকৃতি এবং তার জন্যে কোন প্রমান দরকার হয় না। এ প্রসঙ্গে ১ এ এল আর (এডি) পৃষ্ঠা ১, ৪ এক্স পি (এডি) পৃষ্ঠা ১, ১৬ এম এল আর (এডি) পৃষ্ঠা ২১৬, ১৬ বি এল সি (এডি) পৃষ্ঠা ৪৬, ২৪ বি এল সি (এডি) পৃষ্ঠা ৩৬ মামলার সিদ্ধান্ত সমূহ ও উল্লেখ যোগ্য।
তবে বাস্তবে আদালতে জবাবের ক্ষেত্রে আইনকানুন অনুসরন করে জবাব প্রদান করা হয় না। বাদীর আরজী ভালো ভাবে পাঠ না করে বলা হয় বাদী পক্ষের দাখিলী মোকদ্দমার যাবতীয় উক্তি মিথ্যা, ভাক্ত, ফেরবী, পন্ড, অকর্মন্য, বে—আইনী, যোগাযোগী, ষড়যন্ত্র মূলক, অসৎ উদ্দেশ্যে প্রণোদিত এবং বিবাদীকে হয়রানী ও খরচান্ত করার জন্যে মামলা করা হয়েছে। বাদী পক্ষের মোকদ্দমা দাখিলের কোন কারণ নাই। কারণ অভাবে মামলা সরাসরি ডিসমিস হবে। বাদীর মোকদ্দমা অত্র আকারে প্রকারে অচল।
বাদীর মামলা তামাদি দোষে বারিত। বাদীর মামলা পক্ষ ভাব দোষে বারিত, বাদীর মামলা হস্পট দোষে বারিত। তাছাড়া বাদীর আরজীর সম্পূর্ণ বক্তব্যে বা,বা যোগে অস্বীকার করা হয়। তার পর প্রকৃত বৃত্তান্ত এই যে দিয়া শুরু করা হয়। উক্ত প্রক্রিয়ায় আদালতের পক্ষে বিচার্য বিষয় নির্ণয় করা কঠিন হয়। পক্ষগণ ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হয়। বাদীর প্রতিটি বক্তব্যের বিষয়ে বিবাদীর সুনির্দিষ্ট বক্তব্যে থাকলে খুব দ্রুত পক্ষদের মধ্যে বিচার্য বিষয় নির্ণয় করা যেত। বিজ্ঞ বিচারক তখন দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি করতে পারত। আর আইনানুসারে জবাব দাখিলের সাথে সাথে যে দলিল জমা দেওয়ার কথা তাও অনেক সময় বিবাদী দেয় না। কিন্তু তা না হওয়ায় পরবর্তীতে আদালতে প্রশ্নমালা সরবরাহ ও জবাব দান, দলিলের তথ্যে স্বীকার ও সাক্ষ্য হিসাবে পেশযোগ্য দলিল বা অন্য কোন বস্তুগত পদার্থ আবিষ্কার, ও পরিদর্শন সংক্রান্তে অনেক সময় ব্যয় হয়।
অথচ ঘটনা বা আইনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যখন কোন একপক্ষ নিশ্চিত করে বলে এবং অপর পক্ষ অস্বীকার করে তখন বিচার্য বিষয়ের উদ্ভব হয়। এক পক্ষ কতৃক দৃঢ়ভাবে বিবৃত এবং অপর পক্ষ কর্তৃক অস্বীকৃত প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় একটি স্বতন্ত্র বিচার্য বিষয় সৃষ্টি করে। এটি ঘটনা সংক্রান্ত হতে পারে কিংবা আইন সংক্রান্ত হতে পারে। আদেশ ১৪ নিয়ম ৫ অনুসারে আরজী জবাব পাঠ করার পর এবং পক্ষদের পরীক্ষা করার পর উক্ত দুই প্রকার বিচার্য বিষয় গঠন করা হয়। আদেশ ১৫ নিয়ম ১অনুসারে প্রথম শুনানীতে পক্ষদের মধ্যে আইন সংক্রান্ত কিংবা ঘটনা সংক্রান্তে কোন বিষয় না থাকলে আদালত তৎক্ষনাৎ রায় ঘোষনা করতে পারে।
পরবর্তীতে বিচার্য বিষয় সংক্রান্তে শুধু স্বাক্ষ্য নেওয়া হয়। আদেশ ২০ নিয়ম ৫ অনুসারে যে সকল বিচার্য বিষয়ে ঘটিত হয়েছে তার উপর কারণ সহ পর্যবেক্ষণ অথবা সিদ্ধান্ত বিবৃত করে রায় প্রদান করা যায়। কিন্তু শুরুতেই জবাব গোলেমেলে হলে তা দেওয়ানী মামলার কার্যক্রমকে দীর্ঘায়িত করে। তাই আইন অনুসারে জবাব প্রদান করা উচিত।