রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বলে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিধান নিয়ে করা রিট আবেদন খারিজ (রুল ডিসচার্জ) করে হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এই অভিমত এসেছে।
রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিধান চ্যালেঞ্জ করে ৩৬ বছর আগে করা ওই রিট আবেদন খারিজ করে ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ রায় দেন বিচারপতি নাইমা হায়দারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল।
৫২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়। রুল খারিজ করে দেওয়া রায়টি লিখেছেন বেঞ্চের নেতৃত্বদানকারী বিচারপতি নাইমা হায়দার। এর সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বেঞ্চের অপর দুই বিচারপতি।
রায়ের অভিমতে বলা হয়, অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ২ক যুক্ত করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। তবে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল রায়ে পৃথক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন।
বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নাইমা হায়দারের লেখা রায়ে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ হিসেবে বলা হয়, সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের স্বীকৃতি দেওয়া সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকেও আঘাত করে না। সংবিধানের ২ (ক) অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত মৌলিক নীতিগুলো এবং অন্য কোনো বিধানের সঙ্গেও অসঙ্গতিপূর্ণ নয়।
হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, সংবিধানে ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম মর্যাদা’ প্রদান করা হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজনৈতিক মর্যাদা প্রদানের বাধ্যবাধকতা নেই। অনুচ্ছেদ ২ (ক) অবশ্যই সামগ্রিকভাবে পড়তে হবে এবং পড়লে এটা সুস্পষ্ট হয়, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার ধারণার সন্নিবেশ কোনোভাবেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করে না। এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকেও প্রভাবিত করে না এবং সংবিধানে বাহুল্যতাও সৃষ্টি করে না।
রায়ে বলা হয়েছে, তর্কিত এই সংশোধনী সংবিধানে সন্নিবেশিত রাষ্ট্রধর্ম ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকেও প্রভাবিত করে না। অতএব, আমরা মনে করি, তর্কিত সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ২ (ক) সন্নিবেশ করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সংবিধানবিরোধী নয়। বিষয়টিকে সহজ করার প্রয়াস হিসেবে উপস্থাপিত যুক্তিতর্ক আমরা আমাদের রায়ে আলোচনা করেছি। রিট আবেদনকারী এবং বিবাদী পক্ষের আইনজীবীদের সুনির্দিষ্ট আইনগত যুক্তিগুলো আমরা রায়ে প্রকাশ করা থেকে বিরত থেকেছি। কারণ সাংবিধানিক বিষয় ‘সামগ্রিকভাবে’ আলোচনা করা উচিত। উপরোক্ত আলোচনার আলোকে রুল খারিজ করা হলো।
রায়ে বিচারক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধর্মকে যে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, সেই বিষয়টিও তুলে ধরেছেন। রায়ের এ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন বিচারপতি কাজী রেজাউল হক।
তবে পৃথক পর্যবেক্ষণে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল বলেছেন, পঞ্চম সংশোধনীর মতোই সপ্তম সংশোধনীর মূল উদ্দেশ্য ছিল সামরিক শাসন বৈধ করা এবং সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠাকারীকে বাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ থেকে রক্ষা করা। এই সংশোধনীতে দেশ অথবা জনগোষ্ঠীর স্বার্থ কোথায়? সামরিক স্বৈরশাসন সংজ্ঞাগতভাবেই ধর্ম, নীতি ও আদর্শের তোয়াক্কা করে না। অথচ তারা অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে ঘোষণা করল। দেশে কোনো ধর্মীয় সংকট ছিল না, ছিল না কোনো সাংবিধানিক সংকট। তা ছাড়া এ বিষয়ে জনগণের পক্ষ থেকে কোনো দাবিও উত্থাপিত হয়নি।
রায়ে বলা হয়, আশির দশকের স্বৈরশাসকরা রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা ব্যতিরেকে যা কিছু করেছেন, তার সবই অধর্ম, অন্যায়, নীতিহীনতা, প্রতারণা, লুটতরাজ ও বল্লাহীন দুর্নীতি। সন্ত্রাস ও কুশাসন এসব কিছু মিলেই এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে এ দেশের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ দীর্ঘ ৯ বছর ধরে এই স্বৈরশাসনের অবসানের জন্য সংগ্রাম, ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গ করেছে।
১৯৮৮ সালে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সংযুক্ত করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সংবিধানে ২ক অনুচ্ছেদ যুক্ত করে বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাবে। তখন স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে ওই বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন ১৫ জন বরেণ্য ব্যক্তি।
রিট আবেদনের ২৩ বছর পর ২০১১ সালের ৮ জুন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল দেন। সেদিন আদালত অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের সহায়তাকারী) হিসেবে ১৪ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর নাম ঘোষণা করে আদেশ দেন।
এর প্রায় পাঁচ বছর পর ২০১৬ সালের ৮ মার্চ রুল শুনানির জন্য আদালতে ওঠে। সেদিন আদালত অ্যামিকাস কিউরি মনোনীত করার আদেশ প্রত্যাহার করেন। ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ রিটটি খারিজ করে রায় দেওয়া হয়। আদালত বলেন, এই রিটে আবেদনকারীর আবেদনের এখতিয়ার নেই।
প্রসঙ্গত, পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানে ২ক অনুচ্ছেদ সংশোধনী আনা হয়। এতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সম অধিকার নিশ্চিত করবেন।’