মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী : কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিস সহায়তা না করলে আমাদের সুখের সংসার তছনছ হয়ে যেতো। আমাদের কলিজার টুকরো একমাত্র সন্তানটি পিতা পেলে, মাতা পেতো না, মাতা পেলে পিতা পেতোনা। হয়তো সন্তানটি বড় হয়ে তার জীবনের অপূর্ণাঙ্গতা বুঝতে পারতো। অসহায় অবস্থায় আমাদের সারাজীবন কাটাতে হতো। কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিস বিপর্যস্ত আমাদের সেই সাংসারিক জীবনকে আবারো গুছিয়ে দিয়েছে। ফিরিয়ে দিয়েছে সাংসারিক জীবনে সুখের ঝর্নাধারা। এই কথা গুলো আবেগ আর উচ্ছাস নিয়ে বলছিলেন, আনোয়ারা বেগম ও হামিদ হোসেন দম্পতি।
কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সমিতি পাড়ার নুর আহমদ ও দিলদার বেগমের পুত্র হামিদ হোসেন (৩৯)। কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের বাককুম পাড়া গ্রামের মৃত কামাল হোছাইন ও রহিমা খাতুনের কন্যা আনোয়ারা বেগম (৩৩)। উভয়ে অতি দারিদ্র্য পরিবারের সন্তান। তাদের মধ্যে সামাজিকভাবে আড়াই লক্ষ টাকা দেনমোহর নির্ধারণ করে ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল বিয়ে হয়। উভয়ের ঔরসে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান জন্ম লাভ করে। নাম রিপা মনি। বয়স আড়াই বছর।
হামিদ হোছাইন পেশায় একজন রিক্সা চালক। জীবনের ঘানি টানতে গিয়ে হামিদ হোছাইনকে রীতিমতো হাঁপিয়ে ওঠতে হয়। তিন বছর আগে হামিদ হোছাইন এর পিতা নুর আহমদ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর মাতা দিলদার বেগমের বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হন। রিক্সা চালক হামিদ হোছাইন তার মায়ের চিকিৎসা খরচ মেটাতে গিয়ে সংসারের অতি প্রয়োজনীয় খরচও আর দিতে পারছিলেননা। এ অবস্থায় ভরণপোষণের অভাবে স্ত্রী আনোয়ারা বেগম তার শিশু কন্যা রিপা মনিকে নিয়ে চকরিয়ার খুটাখালী পিতার বাড়িতে চলে যান।
দীর্ঘ প্রায় এক বছর যাবৎ তাদের মধ্যে আর খুব একটা যোগাযোগ হয়নি। স্থানীয় মুরব্বিদের পরামর্শে আনোয়ারা বেগম কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিসে এসব বিষয় নিয়ে একটি আবেদন করে। আবেদনটি এডিআর (Alternative Dispute Regulation) নম্বর ৭৬২/২০২৩ ইংরেজি হিসাবে ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রেকর্ড করা হয়। এরপর আনোয়ারা বেগম এর স্বামী হামিদ হোছাইন এর কাছে কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে ধার্য্য দিনে উপস্থিত হওয়ার জন্য নোটিশ প্রেরণ করা হয়। তৃতীয় ধার্য্যদিনে চলতি বছরের ৫ মার্চ আনোয়ারা বেগম ও তার স্বামী হামিদ হোছাইন লিগ্যাল এইড অফিসে উপস্থিত হন।
লিগ্যাল এইড অফিসে তারা দু’জনকে বিভিন্নভাবে কাউন্সিলিং করেন কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার (ভা:) ও সিনিয়র সহকারী জজ আবদুল মান্নান। তাদেরকে ভুল বুঝাবুঝি ও মান অভিমানের অবসান ঘটিয়ে কোমলমতি সন্তানের ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে আবারো দাম্পত্য জীবনে ফিরে যেতে উৎসাহিত করেন তিনি। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার আবদুল মান্নান তাঁর সর্বোচ্চটা দিয়ে তাদের ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটাতে সক্ষম হন। পরে একইদিন জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের মধ্যস্থতায় উভয়ের মধ্যে আপোষ মিমাংসামূলক বিরোধ নিষ্পত্তির লিখিত চুক্তি হয়। স্ত্রী আনোয়ারা বেগম এবং স্বামী হামিদ হোছাইন এর সংসারে ফিরে যায়। চুক্তির একমাস পরে আরেকটি ধার্যদিনে তারা আড়াইবছরের ফুটফুটে সন্তান সহ জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে হাসিমুখে আসে এবং তাদের সুখের সংসার বর্ননা করতে থাকে। তাদের মধুর সংসারের জোড়া লাগাতে লিগ্যাল এইড অফিসারের আন্তরিকতায় তারা অভিভূত ও মুগ্ধ। লিগ্যাল এইড অফিসের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতার যেন শেষ নাই। মহান আল্লাহ’র কাছে তারা সরকারের এ মহৎ কার্যক্রমে জড়িতদের জন্য দোয়া করতে থাকেন। একটি সফল এডিআর যেন আরো অনেক এডিআর এর সফলতার দ্বারকে উম্মুক্ত ও সহজ করে দিয়েছে।
তাদের মতে, বিচার, সালিশ, মামলা নাকরেও লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে ভেঙ্গে যেতে উপক্রম হওয়া হাজার হাজার সংসারের বন্ধন ফিরিয়ে আনা যাবে। ভঙ্গুর সংসারে সুখ শান্তি ফেরানো যেতে পারে। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তাদের ফিরে পাওয়া দাম্পত্য জীবন। তারা জানান, অসচ্ছল, নির্যাতিতা, অসহায়, গরীব, তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকেরা সরকারি খরচে বিনামূল্যে আইনী সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি এখনো তৃণমূল পর্যায়ে সকলে খুব বেশি অবহিত নন। এ বিষয়ে আরো বেশি প্রচার প্রচারণা হওয়া উচিত বলে মনে করেন আনোয়ারা বেগম-হামিদ হোছাইন দম্পতি। লিগ্যাল এইড কার্যক্রম আরো প্রচার ও প্রসার ঘটলে হাজার হাজার মানুষ এতে উপকৃত হবে।
লেখক : প্যানেল আইনজীবী, কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি।