এম এ আরাফাত ভূঞা : বর্তমানে সামাজিক ব্যাধির আরেক নাম কিশোর গ্যাং। সমাজের যতরকম অপরাধ রয়েছে সকল অপরাধের সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে আছে কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা। সাধারণত মাদকাসক্ত, ইভটিজিং, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজী, ডাকাতি, চুরি, হামলাসহ নানারকম ছোট-বড় অপরাধের সাথে জড়িয়ে রয়েছে তারা। ১০-১৫ জন কিশোর মিলে গ্যাং তৈরি করে রাস্তাঘাট, পাড়ার বিভিন্ন মহল্লায় চলাফেরা করে জনমনে ভীতি সৃষ্টি করে তারা। প্রায়ই কিশোর গ্যাংদের মধ্যে দলাদলির কারণে ঝগড়া-ঝাটি ও মারধরের ঘটনা ঘটে, যা এলাকাবাসীর মধ্যে বিরক্তির সৃষ্টি করে। এ ছাড়া সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইনস্ট্রাগ্রাম রিলস, টিকটক এবং লাইকিতে বিভিন্ন অস্ত্র-সস্ত্র দেখিয়ে অসহনীয় ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করছে কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা। তাদের এসব ভিডিও কনটেন্টে দেখা মিলে নানা হুমকি-ধামকি। এসব হুমকি-ধামকি একজন আরেকজনকে এবং এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে উদ্দেশ্য করে বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করছে। এসব ভিডিও দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্য কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে এসবে।
ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শিশু-কিশোর অপরাধ বিষয়ক আইন প্রণীত হয়। বেঙ্গল চিলড্রেন অ্যাক্ট, ১৯২২ নামে আইনটি ছিল প্রথম শিশু আইন। ১৯৭৪ সনে আইনটি বাতিল করে শিশু আইন, ১৯৭৪ নামে নতুন করে প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের বিধিমালা বাস্তবায়নের নিমিত্তে ১৯৭৪ সালের শিশু আইন রহিতপূর্বক নতুন আইন প্রণয়ন করা হয় যা শিশু আইন, ২০১৩ নামে পরিচিত। শিশুদের সুরক্ষা দেওয়া ও তাদের বিকাশে সহায়তা করা এবং তার ওপর সংঘটিত নির্যাতনের প্রতিকারই হলো এই আইনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এই আইনে মোট ১০০ টি ধারা রয়েছে। উক্ত আইনের ৪ ধারায় শিশুর সংজ্ঞায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিদ্যমান অন্য কোন আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের উদ্দেশ্যপূরণকল্পে, অনুর্ধ্ব ১৮ (আঠার) বৎসর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসাবে গণ্য হইবে।
শিশুর দ্বারা সংঘটিত অপরাধ ও শাস্তি বিষয়ে উক্ত আইনের ৩৩ ধারায় উল্লেখ আছে যে (১) অন্য কোন আইনে ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোন শিশুকে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা কারাদণ্ড প্রদান করা যাইবে না : তবে শর্ত থাকে যে, কোন শিশুকে যখন এইরূপ কোন মারাত্নক ধরনের অপরাধ সংঘটন করিতে দেখা যায় যে, তজ্জন্য এই আইনের অধীন প্রদানযোগ্য কোন আটকাদেশ আদালতের মতে পর্যাপ্ত নহে, অথবা আদালত যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে শিশুটি এত বেশি অবাধ্য অথবা ভ্রষ্ট চরিত্র যে তাহাকে কোন প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করা চলে না এবং অন্যান্য যে সকল আইনানুগ পন্থায় মামলাটির সুরাহা হইতে পারে উহাদের কোন একটিও তাহার জন্য উপযুক্ত নহে, তাহা হইলে শিশু-আদালত শিশুকে কারাদণ্ড প্রদান করিয়া কারাগারে প্রেরণের জন্য আদেশ প্রদান করিতে পারিবে :
আরও শর্ত থাকে যে, এইরূপে প্রদেয় কারাদণ্ডেরর মেয়াদ তাহার অপরাধের জন্য প্রদেয় দণ্ডের সর্বোচ্চ মেয়াদের অধিক হইবে না : আরও শর্ত থাকে যে, উক্তরূপ কারাদণ্ডে থাকাকালীন যেকোন সময়ে শিশু-আদালত উপযুক্ত মনে করিলে এই মর্মে নির্দেশ প্রদান করিতে পারিবে যে, এইরূপ কারাদণ্ডে আটক রাখিবার পরিবর্তে অভিযুক্ত শিশুকে, তাহার বয়স ১৮ (আঠারো) বৎসর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত, কোন প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানে আটক রাখিতে হইবে।
আইনের ৩৪ ধারায় উল্লেখ আছে, যেকোনো শিশু মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধে দোষী প্রমাণিত হলে শিশু-আদালত তাকে অনূর্ধ্ব ১০ (দশ) বৎসর এবং অন্যূন ৩ (তিন) বৎসর মেয়াদে আটকাদেশ প্রদান করে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আটক রাখার জন্য আদেশ প্রদান করতে পারবে। উক্ত ধারার উপধারা (৩) উল্লেখ আছে, হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি, দস্যুতা বা মাদক ব্যবসা বা অন্য কোন গুরুতর মামলায় অভিযুক্ত শিশুর বয়স ১৮ (আঠার) বৎসর পূর্ণ হইলে এবং মামলাটি আদালতে বিচারাধীন থাকিলে অথবা উল্লিখিত অপরাধের মামলায় আদালতের আদেশ অনুযায়ী আটকাদেশপ্রাপ্ত শিশুর বয়স ১৮ (আঠার) বৎসর পূর্ণ হইলে, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের বা প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ, শিশু-আদালতের অনুমতি গ্রহণ সাপেক্ষে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অনতিবিলম্বে কেন্দ্রীয় বা জেলা কারাগারে প্রেরণ করিবে।
পেনাল কোড, ১৮৬০-এর ৮২ ধারামতে ৯ বছর পর্যন্ত কোনো শিশু অপরাধ করতে পারে না। ৮৩ ধারামতে, ৯ বছরের অধিক এবং ১২ বছরের নিম্নের কোনো শিশু কর্তৃক কৃত কোনো কর্ম অপরাধ হবে না, যদি মনে করা হয় কর্মটি যে অপরাধ উহা অনুধাবন করার মতো পর্যাপ্ত মানসিক পরিপক্বতা শিশুটির ছিল না। বর্তমানে কিশোর অপরাধের সাথে জড়িত কিশোরদের বয়স ১০-১৮ বৎসরের মধ্যে। প্রচলিত আইন অনুযায়ী তারা এখনও শিশু। কাজেই শিশুদের সুরক্ষা দেওয়া, তার ওপর সংঘটিত নির্যাতন এবং তাদের দ্বারা সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের প্রতিকার হবে শিশু আইন, ২০১৩ অনুযায়ী।
কিশোর গ্যাং দমনে এবং বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত থাকার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যখন তাদের আটক করে প্রচলিত আইন মোতাবেক তাদেরকে শাস্তি না দিয়ে তাদের পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দিতে হয়। যাদের অপরাধ মাত্রাধিক তাদের আইন অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সংশোধন কেন্দ্র পাঠানো হয়। সংশোধনাগারে পাঠানোর পর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তাদের কাউন্সেলিং করে অপরাধের পথ থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করেন।
সংশোধনাগারে অবস্থান তথা সাজার মেয়াদ শেষ হলে তাদের মুক্তি দিয়ে পরিবারের কাছে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্ত পরিবারের কাছে ফেরত পাঠানোর পর পুনরায় একই কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে তারা। যখন কিশোরটি বুঝতে পারে অপরাধের জন্য শাস্তি পেতে হয় না তেমন তখন অপরাধের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। কিশোর গ্যাং-এর উদ্ভব এবং বিস্তার রোধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। কিশোর অপরাধ বা কিশোর গ্যাং নির্মূলে বর্তমানে প্রচলিত আইন সংস্কার প্রয়োজন মনে করেছেন সচেতন মহল।
তবে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে ৩ জুলাই অনুষ্ঠিত সরকারের আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক থেকে বিদ্যমান আইনে থাকা শিশুর বয়স ১৮ বছর থেকে কমানোর জন্য আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিককালে কিশোর গ্যাং-এর নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিস্তার রোধে এই প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ১৮ বছর কমানোর বিপক্ষে এক পক্ষ বলছেন বয়স কমিয়ে কেবল শাস্তি প্রদানের পরিধি বাড়িয়ে কিশোর গ্যাংয়ের মতো জটিল সামাজিক সমস্যার সমাধান বাস্তবসম্মত নয়, বরং এটি সমাজে বাল্যবিবাহ, শিশু শ্রমিক বৃদ্ধির মতো আরো নানাবিধ সমস্যাকে প্রকট করে তুলবে। আর তাই এই সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ও বিবেচনায় নেওয়া আবশ্যক।
কিশোর গ্যাং তথা কিশোর অপরাধ নির্মূল করতে প্রচলিত আইন সংস্কার করে কার্যকর ও কঠোর আইন তৈরি করা উচিত। আইন সংস্কারের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবারিক সচেতনতায় গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন।