বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষায় বিভিন্ন রিপোর্টে প্রকাশিত এই বিভাগের দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণসহ দুর্নীতি দমনে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) -এর পক্ষ থেকে ১৯ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
এইচআরপিবি এর উদ্যোগে শনিবার (২৫ মে) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘দুর্নীতি দমনে নাগরিকদের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনার সংগঠনের প্রেসিডেন্ট সিনিয়র এডভোকেট মনজিল মোরসেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম বাংলাদেশ এর প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন রশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, প্রাক্তন সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামিম হায়দার এবং এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহি সম্পাদক জ ই মামুন।
যৌথভাবে সভা পরিচালনা করেন HRPB সেক্রেটারি এডভোকেট মোঃ ছারওয়ার আহাদ চৌধুরী ও ভাইস প্রেসিডেন্ট এডভোকেট একলাছ উদ্দিন ভুইয়া।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, দুর্নীতি রেখে উন্নয়ন হলেও তা কখনও টেকসই হবেনা। নাগরিকরা যদি দায়িত্ব পালনে সচেতন হন এবং পারিবারিক পর্যায়ে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখেন তবে ফলাফল আশাপ্রদ হবে।
তিনি বলেন, অধিকাংশ আভিযোগে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য থাকে না, যার কারণে কোন প্রমাণ ছাড়া মামলা দায়ের সম্ভব হয়না।
তিনি আরও বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন হয় তবে দুদকে অভিযোগই আসবে না।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নাগরিকরা সচেতন না হলে দুর্নীতি কমান সম্ভব হবে না। দুর্নীতি দমনে দুদক ইতিমধ্যে স্কুল ছাত্রদের মাঝে প্রচারণা, স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিরোধ কমিটি গঠন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ‘সততা স্টোর’ স্থাপন করে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম বাংলাদেশ এর প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন রশিদ বলেন বর্তমানে কতিপয় নুতন ব্যবসায়ী যারা আগে কখনও ব্যবসা করেননি তারা প্রচুর অর্থের মালিক হয়েছেন।
তিনি বলেন, মানি লন্ডারিং এর সাথে ব্যবসায়ি, সরকারি কর্মচারি, আমলা, রাজনীতিবিদ অনেকেই জড়িত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জণ বলেন, গবেষকরা শত বছর পূর্বেই বলেছেন যে, দুর্নীতি হল আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার তিন বছর পরেই বঙ্গবন্ধু দুর্নীতিবাজদের বিষয় উপলব্ধি করে জনসভায় তার বক্তৃতায় বলেছেন ‘চোররা সব খেয়ে ফেলছে’।
প্রাক্তন সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামিম হায়দার বলেন, দুর্নীতির ছোট ঘটনা তদন্ত না করে বড় ঘটনা তদন্ত করা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক লোন এর মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে কতিপয় প্রভাবশালী সবচেয়ে বড় দুর্নীতির ঘটনা সৃষ্টি করেছেন।
এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহি সম্পাদক জ ই মামুন মামুন বলেন, কতিপয় ক্ষেত্রে মিডিয়াগুলি দুর্নীতি প্রতিরোধে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না, কারণ ঢাল-তলোয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা বিদ্যমান। প্রভাবশালীদের প্রভাবের কারণে সাংবাদিকরা অনেক ক্ষেত্রে রিপোর্টি এ ভয়ভীতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে HRPB এর প্রেসিডেন্ট সিনিয়র এডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন জনসাধারণের প্রত্যাশা পূরণে সফল হয়েছে বলে মনে হয়না, কারন রাঘব বোয়ালরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরাছোয়ার বাইরে থাকেন।
তিনি বলেন, ক্ষমতাশীনরা যদিও দুর্নীতির বিষয় জিরো টলারেন্স এর কথা বলেন কিন্তু বাস্তবতা তা নয়, ক্ষমতার আশেপাশে থেকে অনেকেই দুর্নীতি করলেও তা আমলে নেয়া হয় না।
এসময় তিনি দুর্নীতি দমনে সংগঠনের পক্ষ হতে নিন্মরূপ ১৯ দফা সুপারিশ তুলে ধরেন।
১) কমিশনের সদস্য সংখা ৭ জন ও কর্মরত লোকবলের সংখ্যা ৩ গুন বৃদ্ধি করার জন্য আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২) দুদকের চেয়ারম্যান, কমিশনার ও কর্মকর্তাদের নির্দলীয় মনোভাব, সাহসী ব্যক্তিত্ব এবং দুর্নীতি দমনে অঙ্গীকাকারাবদ্ধ থেকে দুর্নীতি দমনে ভূমিকা রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩) দলমত, পেশা, এলাকা এবং ব্যক্তি পরিচিতির উর্ধ্বে উঠে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সমানভাবে আইন প্রয়োগ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৪) দুদকের প্রত্যেক মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে দুদকের আইন ও বিধি সুনির্দিষ্টভাবে অনুসরণ করতে হবে, ব্যত্যয় ঘটলে কমিশন কর্তৃক তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫) উচ্চপদস্থ ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ হলে সেক্ষেত্রে অনুসন্ধান, তদন্ত দ্রুত সময় শেষ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উক্ত অনুসন্ধান বা তদন্ত মনিটরিং করার জন্য উপরস্ত কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে টিম গঠন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬) দুদকে ডেপুটেশনে পদায়নের ক্ষেত্রে তাদের চাকুরি দুদকে ন্যাস্ত করার বিধান করতে হবে। দুদকে চাকুরিরত অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে আভিযোগ, তদন্ত ও শাস্তি, দুদক আইনে দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৭) দুদকে কর্মরত সকলের সম্পদের হিসাব ২ বছর পরপর জনগণকে অবহিত করার জন্য দুদকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৮) বিভিন্ন রিপোর্টে বিচার বিভাগের দুর্নীতির বিষয়ে বলা হচ্ছে, বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য সেসব রিপোর্ট সম্পর্কে দুদককে তদন্ত করার কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৯) দুদকে কর্মরত যে সকল ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসবে তাদের বিষয় দুদকের তদন্তের পাশাপাশি গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং তাৎক্ষনিক তদন্ত থেকে বিরত রাখা নিশ্চিত করতে হবে।
১০) দুদকে কর্মরত যে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসলে অধিক গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১১) টেলিফোন ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচারিত অনুসন্ধানি রিপোর্ট প্রচারিত হলে সেসব বিষয় দুদককে সরাসরি অনুসন্ধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১২) দুদকে মামলা দায়েরের পর আসামিকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের বিধান অন্তর্ভুক্ত করে আইন সংশোধন এর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে
১৩) দ্রুত সময়ে মামলার অনুসন্ধান ও তদন্ত সমাপ্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং যারা তা করতে পারবেন তাদেরকে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে
১৪) কোটি টাকার উপরে দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত মামলার তদন্ত কর্মকর্তার উপরে গোয়েন্দা নজরদারির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে সে প্রভাবিত না হতে পারে।
১৫) বিভিন্ন আদালতে মামলা পরিচালনার জন্য অধিক সংখ্যক দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং কোন আইনজীবী আসামি পক্ষ থেকে প্রভাবিত হলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
১৬) জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের মধ্য থেকে দুর্নীতিমুক্ত ব্যক্তিদের খুজে বের করে পুরস্কার ও সনদ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১৭) যে সকল অনুসন্ধান, তদন্ত ১ বছরের মধ্যে শেষ হচ্ছে না সেগুলি তালিকাভুক্ত করে কমিশনের তত্ত্বাবধানে দ্রুত শেষ করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১৮) বিদেশে অর্থ পাচার বা ব্যাংকের অর্থ আত্বসাৎ এর সাথে জড়িতদের তথ্য দুদকের নিকট আসলে বা মিডিয়ায় প্রকাশিত হলে কমিশনকে গুরুত্ব সহকারে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং তাদের ভ্রমন, গাড়ি ব্যবহার, ব্যাংক এর লেনদেন বন্ধ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি বিধান সংযোজন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১৯) ইতোপূর্বে অনেক দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে অনুসন্ধান না করায় ঢালাওভাবে অব্যাহতি পেয়েছেন এবং এ বিষয় মিডিয়ায়ও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মিডিয়ার তথ্য বিবেচনায় নিয়ে অব্যাহতিপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ ও প্রভাবশালীদের বিষয় নথি পুনরায় অনুসন্ধান এর আওতায় আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।