ফৌজদারি মামলায় রায় ঘোষণার আগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাজা দেওয়ার বিষয়ে বিচারিক আদালত ও ট্রাইব্যুনালকে পৃথক শুনানি করতে হবে বলে নির্দেশনা দিয়ে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা লিভ টু আপিলের (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) ওপর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি হবে। এই শুনানির জন্য ২৫ জুলাই তারিখ ধার্য করা হয়েছে।
আজ রোববার (২৬ মে) আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
‘রাষ্ট্র বনাম মো. লাভলু’ শিরোনামে এক মামলায় (এক ডেথ রেফারেন্স) গত বছরের ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি রায় দেন হাইকোর্ট।
রায়ের নির্দেশনায় বলা হয়, দেশের বিচারিক আদালত ও ট্রাইব্যুনালকে রায় ঘোষণার আগে অভিযুক্ত ব্যক্তির সাজা দেওয়ার বিষয়ে পৃথক শুনানি করতে হবে। এ জন্য পক্ষগুলোর চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার আগে একটি তারিখ নির্ধারণ করতে হবে।
হাইকোর্টের নির্দেশনা স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করে, যা গত বছরের ২৩ মে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে শুনানির জন্য ওঠে। সেদিন চেম্বার আদালত রায় স্থগিত করে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত লিভ টু আপিল করতে বলা হয়।
এর ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপক্ষ লিভ টু আপিল করে। লিভ টু আপিলটি আজ শুনানির জন্য আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চের কার্যতালিকায় ওঠে।
ক্রম অনুসারে বিষয়টি উঠলে আদালত বলেন, পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনতে হবে। ২৫ জুলাই শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হলো। এই সময় পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করা হলো।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সায়েম মুরাদ। অপর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
হাইকোর্টের রায়ে যা বলা হয়
রায়ে হাইকোর্ট বলেন, দেশের বিচারিক আদালত ও ট্রাইব্যুনালকে রায় ঘোষণার আগে অভিযুক্ত ব্যক্তির সাজা প্রদান বিষয়ে পৃথক শুনানির জন্য নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে।
পদ্ধতি সম্পর্কে রায়ের নির্দেশনায় বলা হয়, পক্ষগুলোর চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক শেষে যখন বিচারক অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা কয়েক বছরের কারাদণ্ডের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করতে মনস্থির করেন, তখন বিচারক তাঁর এই মনোভাবের কথা উন্মুক্ত আদালত বা ট্রাইব্যুনালে পক্ষগুলোর কাছে প্রকাশ করবেন। এরপর বিচারক অভিযুক্ত ব্যক্তির যথাযথ সাজা নির্ধারণের জন্য শাস্তির বিষয়ে পৃথক শুনানির জন্য সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একটি তারিখ নির্ধারণ করবেন।
এ ধরনের শুনানিতে পক্ষগুলো অভিযুক্ত ব্যক্তির সামাজিক পটভূমি, অপরাধের রেকর্ড, বয়স, আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি তুলে ধরতে পারবেন। এ ধরনের শুনানিতে বিচারিক সাজার প্রকৃতি, অপরাধ সংঘটনের পরিস্থিতি, অপরাধীর বয়স ও চরিত্র, ব্যক্তি বা সমাজের প্রতি ক্ষতি; অপরাধী অভ্যাসগত, সাধারণ বা পেশাদার কি না, অপরাধীর ওপর শাস্তির প্রভাব, বিচারে বিলম্ব এবং দীর্ঘদিন চলা বিচারের সময় অপরাধীর ভোগা মানসিক যন্ত্রণা, এমনকি অপরাধীর সংশোধন ও সংস্কারের দিক নজরে রাখতে হবে। এসবের পর বিচারক সাজাসহ দোষী সাব্যস্তকরণ বিষয়ে রায় ও আদেশ দেবেন।
সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে রায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট আদালত ও ট্রাইব্যুনালে নির্দেশসংবলিত রায়ের অনুলিপি পাঠাতে বা এ বিষয়ে সার্কুলার জারি করতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রমের জন্য রায়ের অনুলিপি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক সচিব বরাবর পাঠাতেও বলা হয়েছে।
মামলার নথিপত্র থেকে জানা যায়, যশোরে এক শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়। এই মামলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ২০১৭ সালের ৩০ মে মো. লাভলুকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য বিচারিক আদালতের রায়সহ নথিপত্র হাইকোর্টে আসে, যা একই বছর ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়।
বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জেল আপিল ও আপিল করেন লাভলু। একসঙ্গে শুনানি শেষে গত ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে লাভলুকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।