মীর হালিম: সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদী মনা আইনজীবীদের মাঝে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি সমর্থিত “বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম” দেশব্যাপী জাতীয়তাবাদী আইনজীবীদের সংগঠন।
গত ০৮ অক্টোবর ২০২২ ইং তারিখে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের অনলাইন উপস্থিতিতে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের প্রতিটি জেলা শাখা থেকে আগত প্রতিনিধি কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয়।
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মদ আলী সভাপতি ও বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল মহাসচিব নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ইং তারিখে ১১৮ সদস্য বিশিষ্ট আংশিক কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন হওয়ার পথে বলে জানা যায়।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সমর্থনে উক্ত নির্বাচনে ১৪টি পদের বিপরীতে সভাপতি ও ৩টি সদস্য সহ মোট ৪টি পদে বিজয়ী হয়। বিজয়ীদের সাথে সরকার দলীয় সমর্থক আইনজীবীদের আঁতাত সন্দেহে ফোরাম শপথ নেয়া থেকে বিরত থাকতে সভাপতি সহ বিজয়ীদেরকে চিঠি দেয়। তারা সতর্কতামূলক চিঠি উপেক্ষা করে শপথ গ্রহণ করায় বিশেষত সভাপতি কে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এর প্রতিক্রিয়ায় বিজয়ীরা অসম্মানজনক আচরণের অভিযোগে প্রতিবাদ মিছিল ও সংবাদ সম্মেলন করে। সংবাদ সম্মেলনে আপত্তিকর বক্তব্য রাখায় দ্বন্দ্ব আরো চরমে পৌঁছে। উনাদের মূল দাবি ফোরামের কমিটিতে সিনিয়র ও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হয়নি এবং এই বহিষ্কারাদেশ যথাযথ নয়। ফোরামের মূল সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ ও সমঝোতায় বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
আশা করা যাচ্ছিল এরপরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু সে রকমটি ঘটেনি। বিজয়ীদের সমর্থক কিছু আইনজীবী, বিভিন্ন কারণে বিএনপির ও ফোরাম থেকে বহিষ্কৃত কিছু আইনজীবী, ফোরামের সর্বশেষ ঘোষিত কমিটিতে পদ বঞ্চিত কিছু আইনজীবীরা একত্রিত হয় এবং প্রাথমিকভাবে “জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম” নামে নানারকম প্রচারণা চালায়।
পরবর্তীতে তারা “মরহুম বিচারপতির টিএইচ খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম” নামের ব্যানারে শহীদ প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪৩তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে নানা রকম কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নেয়। সমালোচকরা বলে বেড়ায় এদের পেছনে ষড়যন্ত্রের হাত রয়েছে।
এতে করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই এটিকে দলছুট ফড়িংয়ের আচরণের সাথে তুলনা করেছেন। অনেকেই কবি নজরুলের “ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান” এর সাথে তুলনা করেছেন।
কথিত আছে তারা সরকারের এজেন্ট হিসেবে ফোরামের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করছে। এসবের ফলে বিএনপি তথা জাতীয়তাবাদী মনা আইনজীবীদের মধ্যে একটি সংশয় কাজ করছে।
“বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম” নাকি “জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম” কোনটি সঠিক এবং কাদের সাথে যাওয়া উচিত!
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ঘোষণাপত্র এবং ১৯ মার্চ ২০১৬ ইং তারিখ পর্যন্ত সংশোধিত গঠনতন্ত্র দেখা যেতে পারে। গঠনতন্ত্রের ১২ ধারায় অঙ্গ সংগঠন ও ১৩ ধারায় সহযোগী সংগঠন সম্পর্কে বলা হয়েছে।
১৩ ধারা মতে বিভিন্ন শ্রেণী পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিগণের মধ্যে যারা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নীতি, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচিতে বিশ্বাস করেন তারা স্ব-স্ব শ্রেণী পেশার স্বার্থ রক্ষার জন্য সংগঠিত হতে পারবেন এবং দলের চেয়ারম্যানের অনুমোদনক্রমে এইসব সংগঠন দলের সহযোগী সংগঠন হিসেবে গণ্য হবে। তবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল স্ব-স্ব গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত হবে।
১২ ধারা মতে “দলের এক বা একাধিক অঙ্গ সংগঠন থাকতে পারে। এই সকল অঙ্গ সংগঠনের নিজস্ব ঘোষণা পত্র, গঠনতন্ত্র, পতাকা ও কার্যালয় থাকবে এবং এই সকল অঙ্গ সংগঠন মূল দলের শৃঙ্খলার আওতাধীন থাকবে।
দলের চেয়ারম্যান শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য কিংবা সংগঠন পরিপন্থী কর্মকান্ডের জন্য কিংবা অসদাচরণের জন্য যে কোনো সময় অঙ্গসংগঠনের কর্মকর্তা বা সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন এবং সংগঠন থেকে তাকে বহিষ্কার করতে কিংবা সাময়িকভাবে সংগঠনের সদস্যপদ স্থগিত করতে কিংবা তিরস্কার করতে এবং নির্দেশ বা পরামর্শ দিতে পারবেন।
অঙ্গ সংগঠন হিসেবে দলের চেয়ারম্যানের অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত কোনো সংগঠন জাতীয়তাবাদী দলের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে বিবেচিত হবে না। অনুমোদনের তারিখ হতে অঙ্গ সংগঠনের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হবে। দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটি প্রত্যেক অঙ্গ সংগঠন সম্পর্কিত একজন সম্পাদক থাকবে।
যাদের সমন্বয়ে অঙ্গ সংগঠন গঠিত তাদের কল্যাণ সাধন এবং তার পাশাপাশি দলের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করাই হবে অঙ্গ সংগঠনের মুখ্য উদ্দেশ্য এবং এ উদ্দেশ্যে নিজ নিজ ক্ষেত্রে দলের প্রভাব বিস্তার কিংবা দলের নীতির প্রসারের উদ্দেশ্যে এ সংগঠন তাদের নিজস্ব কর্মসূচি প্রণয়ন করবে।
তবে অঙ্গসংগঠনসমূহের ঘোষণাপত্র, গঠনতন্ত্র এবং পতাকা চেয়ারম্যান কর্তৃক পূর্বেই অনুমোদিত হতে হবে এবং যদি কোন অঙ্গ সংগঠন তাদের ঘোষণাপত্র, গঠনতন্ত্র বা পতাকার কোন প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা সংশোধন করতে চায় তাহলে চেয়ারম্যানের পূর্বানুমোদন ছাড়া তার কোনটাই কার্যকর করা যাবে না।
দল অঙ্গ সংগঠনের এ সকল কর্মসূচি বাস্তবায়নে তাদের সক্রিয়ভাবে সাহায্য করবে। এপর্যন্ত যে সমস্ত সংগঠন দলের চেয়ারম্যানের অনুমোদন পেয়ে অঙ্গ সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে তারা হচ্ছে –
১. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল
২. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল
৩. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মহিলা দল
৪. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা
৫. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দল
৬. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল
৭. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী তাঁতি দল
৮. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ওলামা দল
৯. বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মৎস্যজীবী দল
দুটি ধারা বিশ্লেষণ করলে পেশাজীবীদের সংগঠন সমূহকে সহযোগী সংগঠন বলা যেতে পারে। এসব সহযোগী সংগঠনের নাম কিংবা গঠনতন্ত্রের বিষয়ে বাধ্যবাধকতার উল্লেখ নেই যেখানে অঙ্গ সংগঠনের কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। মরহুম বিচারপতি টি এইচ খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত “জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম” কিংবা এর ধারাবাহিক রূপ “বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম” কোনোটিই এখনও পর্যন্ত ১৩ ধারায় বর্ণিত শর্ত পূরণ করে না কিংবা বিএনপি’র গঠনতন্ত্রে অঙ্গ সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত নয়।
মরহুম বিচারপতি টি এইচ খানের নেতৃত্বে “জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম” গঠিত হয় যার সাথে পরবর্তীতে বাংলাদেশ শব্দটি যোগ করা হয়েছে। সারাদেশের জাতীয়তাবাদী মনা আইনজীবীদের সংগঠন “বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম” হল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তথা বিএনপি কর্তৃক অনুমোদিত একটি বৃহৎ শক্তিশালী পেশাজীবী সংগঠন।
বিএনপি সমর্থিত বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ (বিএসপিপি) এর অন্যতম সমন্বয়ক হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। আন্দোলন সংগ্রামকে বেগবান করার জন্য সর্ব দলীয় আইনজীবীদের সংগঠন “ইউনাইটেড লইয়ার্স ফ্রন্ট” এর ও অন্যতম সহযোদ্ধা।
বিগত বছরগুলোতে “বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম” বিএনপি’র মূল দাবি লুন্ঠিত ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার ও নিখোঁজ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার সংগ্রামী অন্যতম সহযোগী হিসেবে সকল আন্দোলন কর্মসূচিতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেছে। রাজপথ থেকে সুপ্রিম কোর্টের আঙ্গিনা সহ সারা দেশে ফোরামের সমর্থনে আইনজীবী নেতাকর্মী সদস্য শুভাকাঙ্খীরা আন্দোলন সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে এবং এখনো চলমান আছে।
২৮ শে অক্টোবর ২০২৩ সালে নয়াপল্টনের মহাসমাবেশে ক্র্যাকডাউনের পর দৃশ্যত বিএনপি রাজপথ ও সারাদেশে কোন জায়গায় আন্দোলন করার সুযোগ পাচ্ছিল না। সেই সংকট মুহূর্তে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আঙ্গিনা ও বহিরাঙ্গন সংযুক্ত রাজপথ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কর্মসূচিগুলি সারাদেশের মানুষের জন্য ছিল আশা জাগানিয়া। ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল ছিল আইনজীবীদের আন্দোলন।
আমরা জাতীয়তাবাদী মনা আইনজীবীরা এসব কাদা ছোড়াছুড়ি ভুলে বিএনপি কর্তৃক অনুমোদিত “বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম” এর নেতৃত্বে আগামীর বাংলাদেশে “গণতন্ত্র ও মানবাধিকার” প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে যোগ দিব। সম্মান প্রদর্শন করব শহীদ জিয়ার আদর্শের প্রতি, খালেদা জিয়ার অন্যায় বন্দিদশা আর তারেক রহমানের নির্বাসিত সংগ্রামী জীবনের জন্য। আরও সম্মান প্রদর্শন করব স্বৈরশাসনের গ্যারাকলে পরে থাকা অন্ন বস্ত্র চাকুরী ও অর্থহীন সেই সব মলিন মানুষদের সংগ্রামী মিছিলের প্রতি যারা গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার শপথে বলিন।
সুপ্রিম কোর্টে উদ্ভূত এই সংকট নিরসনে মহান নেতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শই পথ দেখাতে পারে। শহীদ জিয়া সমন্বয়, সহনশীলতা, সমঝোতা ও বহুদলীয় রাজনৈতিক গণতন্ত্র বিশ্বাসে ও বাস্তবায়নে সফল হয়েছিলেন। জিয়ার আদর্শই আমাদের বাতিঘর। জিয়াই আমাদের পথ প্রদর্শক। শহীদ জিয়া অমর হোক। বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সদস্য ও পাবলিক পলিসি অ্যানালিস্ট। email: adv.mirhalim@gmail.com