দীপজয় বড়ুয়া: সাধারণ অর্থে খালাস অর্থ হল ফৌজদারি আইনে আদালত কর্তৃক আসামী বা আসামীদের নির্দোষতার স্বীকারোক্তি। এই ধরনের রায় একটি বিচারে জুরি দ্বারা বা বিচারকের দ্বারা করা যেতে পারে যিনি শাসন করেন যে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার জন্য বা পরবর্তী কার্যধারার জন্য অপর্যাপ্ত প্রমাণ নেই। একটি খালাস আইনের সমস্ত অপরাধ দূর করে। একটি খালাস “আসলে” ঘটে যখন একটি জুরি আসামীকে দোষী না বলে মনে করে। একটি খালাস “আইনে” নিছক আইনের অপারেশনের মাধ্যমে ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি মামলায় অধ্যক্ষ খালাস পান, তবে একটি আনুষঙ্গিককেও আইনে খালাস বলে গণ্য করা হয়।
ব্যাপক অর্থে, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ২৪৫ ও ২৬৫-জ ধারায় বেকসুর খালাস সম্পর্কে বলা হয়েছে । ফৌজদারী কার্যবিধির ২৪৫ ধারা ম্যাজিস্ট্রেটকে খালাসের আদেশের ক্ষমতা প্রদান করেছে। এই ধারা মতে-‘ম্যাজিস্ট্রেট যদি ২৪৪ ধারায় উল্লেখিত সাক্ষ্য এবং তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যে অতিরিক্ত সাক্ষ্য (যদি থাকে) হাজির করতে বলেন, উক্ত সাক্ষ্য গ্রহণ করে এবং আসামীর জবানবন্দী গ্রহণ করে আসামীকে নির্দোষ বলে সাব্যস্ত করেন, তাহলে তিনি খালাসের আদেশ লিপিবদ্ধ করবেন।’
ফৌজদারী কার্যবিধির ২৬৫-জ ধারা দায়রা জজকে খালাসের আদেশ দানের ক্ষমতা প্রদান করেছে। এই ধারা মতে-‘বাদীপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ, আসামীর জবানবন্দী গ্রহণ এবং বাদীপক্ষ ও আসামীপক্ষের বক্তব্য শ্রবণ করে আদালত যদি মনে করেন যে, আসামী অপরাধ করেছে এরূপ কোন সাক্ষ্য নাই, তাহলে আদালত আসামীকে খালাস দেয়ার আদেশ লিপিবদ্ধ করবেন।
37 DLR 107 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, বাদীপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ, আসামীকে পরীক্ষাকরণ, উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনা এবং আসামী অপরাধ করেছে মর্মে কোন সাক্ষ্য নেই হিসাবে মতামত প্রকাশ করার পর ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ২৬৫-জ অনুযায়ী আদেশ দিতে দায়রা জজকে আইন ক্ষমতা প্রদান করে।
51 DLR (AD) 159 Latifa Akhter and others Vs. The State and another মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “২৬৫-জ ধারা দায়রা আদালতে কোন বিচারে দোষী সাব্যস্তের খালাস নিয়ে আলোচনা করে, আর ২৪৫ ধারা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক খালাস নিয়ে আলোচনা করে । এ দুই ধারানুসারে কোন দোষী সাব্যস্তকে বিচারের জন্য আদালতে আনা হলে আদালত পক্ষদ্বয়ের বক্তব্য শুনে ও মামলার নথি এবং দলিল বিবেচনাপূর্বক দোষী সাব্যস্তকে খালাস দিতে পারেন”।
38 DLR 303 (AD) Mrs. Amena Hoque Vs. Rajab Ali মামলায় বলা হয়েছে যে, “২৩ অধ্যায়ের বিধানাবলী অনুসারে খালাসের আদেশ ২৬৫-জ ধারায় বৈধভাবে দেয়া যাবে । উক্ত ধারায় বলা হয়েছে যে, আদালত বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার পরে অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করার মত কোন সাক্ষ্য নেই বলে বিবেচনা করলে খালাসের আদেশ দেয়া যাবে”।
কোন ব্যক্তি বিচারে, একবার সাজা বা খালাস পেলে একই অপরাধের জন্য আবার বিচারের সম্মুখীন হতে পারে না। এটি সেই নীতির উপর যাকে বলে, ‘নেমো ডিবেট বিস ভেকসারী’। যার অর্থ হলো-কোন ব্যক্তিকে দ্বিতীয়বারের জন্য বিচারাধীন করা যাবে না সে অপরাধের জন্য, যে অপরাধে তার একবার বিচার হয়েছে। এই নীতি বাক্যটির প্রতিফলন ঘটেছে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪০৩ ধারায়। এই ধারায় বলা হয়েছে যে,
(১) কোন উপযুক্ত এখতিয়ারবান আদালতে যেক্ষেত্রে কোন অপরাধের জন্য সে লোকের একবার বিচার হয়েছে এবং উক্ত অপরাধের জন্য সাজা দান করা বা অপরাধ হতে খালাস দেয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রে উক্ত খালাস বা সাজা বলবৎ থাকার সময় তাকে একই অপরাধের জন্য পুনরায় বিচার করা যাবে না, অথবা একই ঘটনা হতে সৃষ্ট অন্য কোন অপরাধের জন্যও পুনরায় তার বিচার করা যাবে না, যে অপরাধের জন্য তার বিরুদ্ধে ২৩৬ ধারা অনুযায়ী একটি পৃথক অভিযোগ আনয়ন করা যেত বা যার জন্য তাকে ২৩৭ ধারা অনুযায়ী সাজাপ্রাপ্ত করা যেত।
(২) কোন অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত বা খালাসপ্রাপ্ত কোন লোককে পরে এমন একটি পৃথক অপরাধের জন্য বিচার করা যাবে, যে অপরাধের জন্য পূর্ববর্তী বিচারে ২৩৫ ধারার (১) উপধারার অধীন তার বিরুদ্ধে একটি পৃথক অভিযোগ আনয়ন করা যেত।
(৩) যেক্ষেত্রে কোন লোক কোন কার্য কর্তৃক সৃষ্ট কোন অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হয় এবং উক্ত কার্য ও উহার প্রতিক্রিয়া সমন্বয়ে তদপেক্ষা ভিন্ন ধরনের একটি অপরাধ সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে উক্ত প্রতিক্রিয়া না ঘটে থাকে বা ঘটেছে বলে আদালত অবহিত না থাকলে তাকে এরূপ শেষোক্ত অপরাধে পরবর্তীতে বিচার করা যাবে।
(৪) কোন লোক কোন কার্যধারা সৃষ্ট অপরাধ হতে খালাস বা উহার জন্য সাজাপ্রাপ্ত হলে অত্র খালাস বা সাজা একই কার্য কর্তৃক সৃষ্ট অন্য কোন অপরাধের জন্য তাকে অভিযুক্ত ও বিচার করা যাবে, যদিও যে আদালতে তার প্রথম বিচার হয়েছিল সেই আদালত পরবর্তী অপরাধের বিচার করার জন্য উপযুক্ত নন।”
(৫) এই ধারার কোন কিছুই জেনারেল ক্লজেজ এ্যাক্ট এর- ২৬ ধারা বা এই বিধির ১৮৮ ধারার কোন বিধানকে প্রভাবিত করবে না। উদাহরণসমূহ :
(ক) চাকর হিসাবে চুরির অভিযোগে ‘ক’ এর বিচার করা হলো এবং খালাস দেয়া হলো। পরে অত্র খালাস বলবৎ থাকাকালে তাকে চাকর হিসাবে চুরি বা একই ঘটনার ভিত্তিতে কেবল চুরি বা অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গের জন্য অভিযুক্ত করা যাবে না।
(খ) খুনের অপরাধের জন্য ‘ক’ এর বিচার করা হলো এবং খালাস দেয়া হলো, তার বিরুদ্ধে দস্যুতার কোন অভিযোগ নেই, কিন্তু ঘটনা হতে প্রতীয়মান হয় যে, খুনের সময় ‘ক’ দস্যুতা করেছিল, পরে তার দস্যুতার জন্য অভিযুক্ত ও বিচার করা যাবে।
(গ) গুরুতর আঘাত করার জন্য ‘ক এর বিচার করে সাজা প্রদান করা হলো। আহত লোক পরে মারা গেল। অপরাধজনক নরহত্যার জন্য পুনরায় ‘ক’ এর বিচার করা যাবে।
(ঘ) ‘ক’ দায়রা আদালতে অভিযুক্ত হয়ে অপরাধজনক ভাবে ‘খ’ এর প্রাণ- নাশের জন্য সাজাপ্রাপ্ত হলো। পরে একই ঘটনার ভিত্তিতে ‘খ’ কে খুন করার দায়ে ‘ক’ এর বিচার করা যাবে না।
33 DLR 231 মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “কোন ব্যক্তি একই অপরাধে দু’বার বিচারের আওতায় আসতে পারে না। এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(২) উল্লেখ করা যেতে পারে। উক্ত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি একই অপরাধে একের অধিকবার বিচারের সম্মুখীন ও দণ্ডপ্রাপ্ত হবে না”।
ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ৪০৩ এর উপধারা (১) এ একই চার্জে কোন আসামী দু’বার বিচারানুষ্ঠানের অনুরূপ নিষেধাজ্ঞা বর্তমান রয়েছে।
সুতরাং বলা যায় যে, সাধারণ আইনের এখতিয়ারে, একটি খালাস মানে হল প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে যে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে উপস্থাপিত অভিযোগের যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের বাইরে দোষী। এটি প্রত্যয়িত করে যে অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধের অভিযোগ থেকে মুক্ত, যতদূর ফৌজদারি আইন সম্পর্কিত।
খালাসের চূড়ান্ততা এখতিয়ারের উপর নির্ভর করে। কিছু দেশে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, খালাস একই অপরাধের জন্য অভিযুক্তের পুনঃবিচার নিষিদ্ধ করে, এমনকি যদি নতুন প্রমাণ পাওয়া যায় যা অভিযুক্তকে আরও জড়িত করে। ফৌজদারি কার্যধারায় খালাসের প্রভাব একই রকম হয় তা জুরির রায়ের ফলে বা অভিযুক্তকে নিষ্পত্তি করে এমন অন্য কোনো নিয়মের ক্রিয়াকলাপের ফলে হয়।
তথ্যসূত্র: ফৌজদারী কার্যবিধি-জহিরুল হক, ফৌজদারী কার্যবিধি- মুহাম্মদ সাইফুল আলম, ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্য-গাজী শামসুর রহমান, শতাধিক বছরের ক্রিমিনাল কেস রেফারেন্স-এডভোকেট কামালউদ্দিন, ক্রিমিনাল কেস রেফারেন্স- জীবরুল হাসান,উইকিপিডিয়া,ল’পোর্টাল, Section Wise 100 years Reference on Crpc, Section Wise 100 years Reference on Penal Code- Md. Abul Kalam Azad।
লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।