৬ দফা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘ আইনি লড়াই করতে হয়

৬—দফা উত্থাপন

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কাশ্মীর প্রশ্নে বিরোধ দেখা দেয়। কাশ্মীর ছিল একটি দেশীয় রাজ্য। জনসংখ্যার অধিকাংশ মুসলমান কিন্তু মহারাজা ছিলেন হিন্দু। দেশ বিভাগের সময় তিনি কাশ্মীরের ভারতে যোগদানের সিদ্ধান্ত ঘোষনা করেন। এ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর প্রশ্নে প্রথম যুদ্ধ সংগঠিত হয়। কাশ্মীরের এক অংশ ‘আজাদ কাশ্মীর’ নামে পাকিস্তানের এবং অধিকাংশ অঞ্চল ‘জম্মু কাশ্মীর’ ভারতের নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের কথা থাকলেও তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। পাকিস্তান ও ভারত উভয়ই কাশ্মীরকে তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাবি করতে থাকে। অমীমাংসিত এই কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর নতুন করে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধে।
বাঙালিদের জন্য ১৯৬৫ সালের পাক—ভারত যুদ্ধ অত্যন্ত শিক্ষনীয় ও তাৎপর্যপুর্ন ছিল। যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান শুধু দেশের পশ্চিম অংশ থেকেই বিচ্ছিন্ন ছিল না, বরং সমগ্র বিশ^ থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর ফলে নিজেদের নিরাপত্তার নিয়ে বাঙালিরা খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। ১৭ দিন যুদ্ধের পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধ বিরতির নির্দেশ দিলে তা উভয় দেশই পালন করে। ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের মধ্যস্থতায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ‘তাসখন্দ চুক্তি’ স্বাক্ষর করে বিরোধ থেকে বেরিয়ে আসে।

৬—দফা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দ্বীর্ঘ আইনি লড়াই করতে হয়

তাসখন্দ চুক্তি নিয়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ চুক্তি পর্যালোচনার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদরা ১৯৬৬ সালের ৫—৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে একটি জাতীয় সম্মেলন ডাকেন। চুক্তি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে অসন্তোষের প্রেক্ষিতে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এ সম্মেলনে যোগদানের ব্যাপারে প্রথম দিকে মনস্থির করতে পারেনি। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নসরুল্লাহ খান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শে শেখ মুজিব সিদ্ধান্ত নেন, তিনি লাহোর যাবেন।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে আওয়ামী লীগের ১০ জনসহ অন্যান্য দলের ১১ জন রাজনীতিবিদ এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৬০০—এর অধিক সদস্য এতে যোগ দেন। ৫ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসায় কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আফজালের সভাপতিত্বে সম্মেলন শুরু হয়। শেখ মুজিব সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটির সভায় ৬—দফা দাবি উত্থাপন করে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক—সাংস্কৃতিক স্বার্থকে উর্ধ্বে তুলে ধরেন। সম্মেলনের আয়োজকগন শেখ মুজিবের ৬—দফাকে এজেন্ডায় রাখতে অসম্মতি জানান। তারা এ নিয়ে কোনো আলোচনা করতেও রাজি হননি। ফলে শেখ মুজিব ক্ষুব্ধ হয়ে সম্মেলন থেকে ওয়াকআউট করেন। ১০ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি ৬—দফাকে বিবৃতি আকারে প্রকাশ করেন।

৬—দফার মূলকথা

৬—দফার হুবহু পাঠ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ প্রকাশিত পুস্তিকা হতে ৬—দফার মূল কথা হলো-

১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান একটি যুক্তরাষ্ট্র হবে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অঞ্চলগুলোকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা, সর্বজনীন ভোটে সরাসরি নির্বাচন এবং আইনসভার সার্বভৌমত্ব থাকতে হবে।
২. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কেবল দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতিতে সীমাবদ্ধ থাকবে।
৩. দুই প্রদেশের জন্য দুটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে। অথবা সমগ্র দেশের জন্য একটি মুদ্রা রাখা যেতে পারে। তবে পূর্ব পাকিস্তান হতে পশ্চিম পাকিস্তানে মুলধন পাচার বন্ধ করার জন্য কার্যকর সাংবিধানিক ব্যবস্থা থাকতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভ এবং পৃথক অর্থ ও মুদ্রাবিষয়ক নীতি থাকবে।
৪. কর নির্ধারনের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের থাকবে না। এ ক্ষমতা অঙ্গরাজ্যের হাতে থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকার অঙ্গরাজ্যের রাজস্বের একটি নির্দিষ্ট অংশ পাবে।
৫. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দুটি পৃথক খাত থাকবে। বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত পূর্ব পাকিস্তানের আয় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের এবং পশ্চিম পাকিস্তানের আয় পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের নিয়ন্ত্রনে থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অঙ্গরাজ্যগুলি মিটাবে। অঙ্গরাজ্যগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্যাদি চলাচলে শুল্ক বা কর জাতীয় কোনো বাধানিষেধ থাকবে না। সংবিধানে অঙ্গরাজ্যগুলিকে বিদেশে বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
৬. আঞ্চলিক সংহতি ও সংবিধান রক্ষার জন্য সংবিধানে অঙ্গরাজ্যগুলিকে নিজ নিয়ন্ত্রনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।

দেশে ফিরে ৬—দফার প্রচার

শেখ মুজিব লাহোরে ৬—দফা দাবি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ফিরে তেজগাও পুরাতন বিমানবন্দরে প্রথম সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। এখানে তিনি গোটা লাহোর সম্মেলনের সঙ্গে তার দলের সম্পর্ক ছিন্ন করার কারন ব্যাখ্যাসহ ৬—দফা কর্মসূচির প্রধান প্রধান দিকগুলো তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন। এভাবে ৬—দফা সর্বপ্রথম জনসন্মুখে প্রকাশ পায়। দেশে ফিরে আসার পর ৬—দফাকে কেউ কেউ ‘পাকিস্তানের অখণ্ডতাবিরোধী’ বলে প্রচার করতে শুরু করলে তিনি তার জবাবে ১৭ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন এবং ‘শক্তিশালী কেন্দ্রের’ প্রবক্তাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন।

পরে ৬—দফাকে অনুমোদনের জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা ডাকা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এ বৈঠকে ৬—দফা আনুষ্টানিক অনুমোদন লাভ করে। এবং একই সভায় ১৮—২০ মার্চ ১৯৬৬ দলের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্টানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রায় একমাস পর কাউন্সিল সভা ডাকার কারনে শেখ মুজিব এর মধ্যে ৬—দফার প্রচার শুরু করা জরুরি মনে করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে প্রথম কোন জনসভায় ৬—দফা নিয়ে শেখ মুজিব বক্তব্য দেন।

এরপর ১৮—২০ মার্চ ঢাকার নটরডেম কলেজের পুবপাশে একতলা বিশিষ্ট ইডেন হোটেল প্রাঙ্গনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে ১৪৪৩ জন কাউন্সিলর শেখ মুজিবুর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারন সম্পাদক এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করে। এ কাউন্সিলে ৬—দফাকে দলের প্রধান ইশতেহার হিসেবে গ্রহন করা হয়। অধিবেশনের শেষ দিন ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানের জনসভায় শেখ মুজিব দলের সভাপতি হিসেবে ৬—দফার পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন। পরে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ৬—দফার ব্যাখ্যাসহ ‘আমাদের বাচার দাবী ৬—দফা কর্মসূচী’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচার সম্পাদক আব্দুল মমিন এটি প্রকাশ করেন।

সাংগঠনিক প্রক্রিয়া শেষে শেখ মুজিব জনগনের মধ্যে ৬—দফা দাবিকে ছড়িয়ে দিতে লাগাতার সভা শুরু করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি ময়দানের পর ২৭ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর মাইজদীকোর্ট টাউন হল ও বেগমগঞ্জ দীঘীরপাড়ে সভা করেন। এরপর ১০ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা , ১৪ মার্চ সিলেট রেজিস্ট্রি অফিস ময়দানে ২০ মার্চ ঢাকার পল্টনে আওয়ামী লীগের সভায় , ২৫ মার্চ চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে , ২৬ মার্চ সন্ধীপ এবং ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া কোর্ট প্রাঙ্গনে ৬—দফা নিয়ে যুক্তিসহকারে বক্তব্য দেন।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শেখ মুজিব উত্তরবঙ্গ সফর করে ৭ এপ্রিল পাবনা টাউন হল ময়দানে , ৮ এপ্রিল বগুড়ার এডওয়ার্ড পার্কে , ৯ এপ্রিল রংপুর , ১০ এপ্রিল দিনাজপুর , ১১ এপ্রিল রাজশাহী , ১৫ এপ্রিল যশোর টাউন হলে এবং ১৭ এপ্রিল খুলনা মিউনিসিপ্যাল পার্কে ছয় দফার ব্যাখ্যাসহ দিকনির্দেশনামুলক বক্তব্য দেন। এরপর ২৯ এপ্রিল কুমিল্লা টাউন হল ময়দানে , ৩ মে ঢাকার কমলাপুর , ৭ মে সিলেট কোর্ট ময়দানে এবং সবশেষ ৮ মে নারায়নগঞ্জ টাউন হল ময়দানে বক্তব্য দেন। এদিনই মধ্যরাতের পর তাকে আটকাদেশ দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি করা হয়। লাহোর থেকে ঢাকা ফিরে আটক হওয়ার আগ পর্যন্ত শেখ মুজিব দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কমপক্ষে ২০টি জনসভায় ৬—দফার ব্যাখ্যাসহ দিননির্দেশনামুলক গুরুত্বপুর্ন বক্তব্য দেন।

৬—দফার প্রতিক্রিয়া

৬—দফা কর্মসূচির প্রতি শেখ মুজিব অন্য কোনো দলের সমর্থন পাননি। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘোষনা করেন, ‘তাহার দল পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে গৃহীত কোনো প্রচেষ্টায় শরীক হইবে না।’ পূর্ব পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগের সহসভাপতি ও জাতীয় পরিষদের সদস্য খাজা খয়েরউদ্দিন এবং সাধারন সম্পাদক এ কিউ এম শফিকুল ইসলাম ১৫ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিবের ৬—দফাকে প্রত্যাখান করে একে ‘ভয়াবহ পরিনতিসম্পন্ন’ এবং ‘পাকিস্তানের জন্য মারাত্মক’ বলে অভিহিত করেন। এমনকি শেখ মুজিবের নিজের দল আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রবীন নেতৃত্বের কেউ কেউ ৬—দফার ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়েন এবং এদের একটি অংশ পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) পন্থী আওয়ামী লীগ দাড় করানোর চেষ্টা করেন। এ নিয়ে ১৩ আগস্ট ১৯৬৬ আওয়ামী লীগের পিডিএম পন্থী নেতারা ঢাকায় আতাউর রহমান খানের বাড়িতে এক বৈঠকে মিলিত হন। যে কোন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সংহতি অটুট রাখা এবং নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিয়ে আলোচনা করাই ছিল এই বৈঠকের প্রধান লক্ষ্য। ৬—দফাবিরোধী এই গ্রুপটি আরো দাবি করে, তাদের আওয়ামী লীগই সত্যিকার আওয়ামী লীগ, ৬—দফার পক্ষের আওয়ামী লীগ বিচ্ছিন্নতাবাদী।

৬—দফা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দ্বীর্ঘ আইনি লড়াই করতে হয়

এ সভায় উপস্থিত ছিলেন মজিবর রহমান (রাজশাহী), অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম খান, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুর রহমান খান, এম এ রশিদ (যশোর), রওশন আলী, মোমেনউদ্দিন আহমেদ (খুলনা), মতিউর রহমান (রংপুর), লকিয়তুল্লাহ (বরিশাল), রহিমুদ্দিন আহমেদ, সাদ আহমেদ, জালাল উদ্দিন আহমেদ ও মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ। অন্যদিকে প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দলই পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষার তাগিদে ৬—দফার বিরুদ্ধাচারন করতে শুরু করে। নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী, এনডিএফ, পিডিএম, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, ন্যাপ এর একটি অংশ ও কনভেনশন মুসলিম লীগ কোনো দলই ৬—দফার পক্ষে অবস্থান নেননি।

৬—দফার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত কঠোর। তিনি ৬—দফার কারনে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ‘একনম্বর শত্রু’ হিসেবে আখ্যা দেন। এবং ৬—দফা আন্দোলনকারীদের ‘অস্ত্রের ভাষা’ প্রয়োগের হুমকি দেন। ইতিহাসের কি শিক্ষা, আইয়ুব খান যতই আক্রমনাত্মক ভাষায় শেখ মুজিবকে আক্রমন করতে থাকেন ৬—দফা এবং শেখ মুজিবের জনসমর্থন ততই বাড়তে থাকে।

৬—দফা নিয়ে মামলা

পাকিস্তানের তেইশ বছরে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মোট ২৫টি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়। তার মধ্যে শুধু ৬—দফাকে কেন্দ্র করেই ৭টি মামলা হয়। ১৯৬৬ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে এসব মামলা হলেও শুধু এপ্রিল মাসেই তার বিরুদ্ধে ৫টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় বঙ্গবন্ধুকে আটকাতে না পেরে ৮ মে ১৯৬৬ এবং ২৯ মে ১৯৬৭ জননিরাপত্তা বিধিতে আটকাদেশ দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি করা হয়।

৬—দফাকে কেন্দ্র করে ঢাকার রমনা থানায় ৮০/১৯৬৬, সন্ধীপ থানায় ৯/১৯৬৬, পাবনা থানায় ৫/১৯৬৬, যশোরের কোতয়ালি থানায় ৩৯/১৯৬৬ ও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানায় ১৭/১৯৬৬ এবং সিলেট জেলায় সি.আর মামলা ১৪১৫/১৯৬৬ ও ময়মনসিংহ জেলায় সি.আর মামলা ৪০৯/১৯৬৬ দায়ের করা হয়।

১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের শেষ দিন শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার পল্টন ময়দানে বক্তব্য দেওয়ার কারনে তার বিরুদ্ধে ১৭ এপ্রিল রমনা থানায় ৮০/১৯৬৬ নম্বর মামলা দায়ের করা হয়। ৬—দফার প্রচারে খুলনায় বক্তব্য দিয়ে ঢাকা ফেরার পথে ১৮ এপ্রিল যশোরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ মামলায় ২৭ এপ্রিল ১৯৬৭ শেখ মুজিবকে ১৫ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিলে তিনি এর বিরুদ্ধে ঢাকার দায়রা জজ আদালতে ৭৪/১৯৬৭ নম্বর আপীল দায়ের করেন। দায়রা জজ ৭ নভেম্বর ১৯৬৭ শেখ মুজিবের দণ্ড কমিয়ে ‘ন্যায়বিচারের খাতিরে’ ৮ মাস বহাল রাখেন। পরে হাইকোর্টে ফৌজদারী রিভিশন ৭৬০/১৯৬৭ মামলা দায়ের করলে ৬ মে ১৯৬৯ শেখ মুজিবের দণ্ড বাতিল হয়।

১৪ মার্চ সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার কারনে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ১৮ এপ্রিল সিলেট জেলা আদালতে নালিশী ১৪১৫/১৯৬৬ নম্বর মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলায় ২১ এপ্রিল শেখ মুজিবকে ধানমণ্ডির বাসা থেকে গ্রেফতার করে সিলেট নেওয়া হয়। ৩ দিন পর তার জামিন হয়। ১৫ এপ্রিল যশোর টাউন হল ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ মুজিবের বক্তব্যের কারনে ২০ এপ্রিল কোতয়ালী থানায় ৩৬/১৯৬৬ নম্বর মামলা দায়ের করা হয়। এ আদালতে তাকে কখনোই হাজির করা হয়নি।

এরপর ১১ মার্চ ময়মনসিংহ টাউন হল ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় বক্তব্যের কারনে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহ জেলা আদালতে নালিশী (সি.আর) ৪০৯(১)১৯৬৬ নম্বর মামলা দায়ের করা হয়। সিলেটের আদালতে জামিন দেওয়ার সাথে সাথে তড়িঘড়ি করে গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে ময়মনসিংহ আদালতে নেওয়া হয়।

২৬ মার্চ সন্ধীপ আওয়ামী লীগের জনসভায় বক্তব্য দেওয়ার কারনে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ২৩ এপ্রিল সন্ধীপ থানায় ৯/১৯৬৬ নম্বর মামলা, ৭ এপ্রিল পাবনা টাউন হল ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় বক্তব্য দেওয়ার কারনে ৮ মে পাবনা থানায় ৫/১৯৬৬ নম্বর মামলা এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি বেগমগঞ্জ থানার দীধীর ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় বক্তব্য দেওয়ার কারনে ২৬ আগস্ট বেগমগঞ্জ থানায় ১৭/১৯৬৬ নম্বর মামলা দায়ের করা হয়। এসব আদালতে শেখ মুজিবকে কখনোই উপস্থাপন করা হয়নি।

এরইমধ্যে ৮ মে নারায়ণগঞ্জ টাউন হল ময়দানের জনসভায় বক্তব্য দিয়ে শেখ মুজিব বাসায় ফিরলে একইদিন পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমতে ঢাকার ডেপুটি কমিশনার তাকে ৩ মাসের আটকাদেশ দেন। এবং রাত ২টায় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে আটক করেন। এ আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করে বন্ধু রেজাউল মালিক পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টে ১৩ মে ফৌজদারি বিবিধ ৬৪/১৯৬৬ মামলা দায়ের করেন। একই আইনে তাজউদ্দীন আহমদ, মোশতাক আহমদ, নুরুল ইসলাম চৌধুরীসহ আরো ৭ জনকে আটকাদেশ দেওয়া হলে তারাও এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন। এসকল মামলা শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের ৫ বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ ৯ আগস্ট ১৯৬৬ সংখ্যাগরিষ্টতার ভিত্তিতে (৪ঃ১) শেখ মুজিবের মামলা খারিজ করেন।

এ আদেশের বিরুদ্ধে শেখ মুজিব পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টে ফৌজদারি আপীল ১১—ডি/১৯৬৭ দায়ের করলে প্রধান বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস—এর নেতৃত্বে ৫ বিচারপতি ১৪ জুন ১৯৬৭ ‘মালিক গোলাম জিলানি এবং অন্যান্য ১৯৬৭ (১৯ ডিএলআর, সুপ্রিমকোর্ট, ৪০৩) মামলার আলোকে হাইকোর্টের মামলাটিকে (৬৪/১৯৬৬) পুনরায় নিস্পত্তি (রি—হিয়ারিং) করতে নির্দেশ দেন।

এরইমধ্যে রমনা থানার ৮০/১৯৬৬ মামলায় শেখ মুজিবকে দণ্ড দেওয়ার কারনে আটকাদেশের মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। কিন্তু আদালত জামিন মঞ্জুর করলে ২৯ মে ১৯৬৭ তড়িঘড়ি করে পুনরায় তাকে ৩ মাসের আটকাদেশ দেওয়া হয়। এ আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করে শেখ মুজিবের পক্ষে শেখ আকরাম হোসেন ২৬ জুন ১৯৬৭ পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টে ১৬১/১৯৬৭ বিবিধ মামলা দায়ের করেন। যুক্তিতর্ক ও তথ্য একইরকম হওয়ায় ফৌজদারি বিবিধ ৬৪/১৯৬৬ ও ১৬১/১৯৬৭ মামলা দুটো একত্রে শুনানি করা হয়। ৩ বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ ৯ আগস্ট ১৯৬৭ সংখ্যাগরিষ্টতার ভিত্তিতে (২ঃ১) শেখ মুজিবের আটকাদেশ বৈধ ঘোষনা করে মামলা দুটো খারিজ করেন।

পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে শেখ মুজিব পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টে ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৭ ফৌজদারি আপীল ২০—ডি/১৯৬৭ দায়ের করেন। এটি চলমান থাকাবস্থায় ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৮ রাত ১২টার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে ঐতিহাসিক আগরতলা মামলায় আটক করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করা হয়। আগরতলা মামলা বিচারাধীন থাকাবস্থায় সুপ্রিম কোর্ট ৯ জুন ১৯৬৯ শেখ মুজিবের আপীল নিস্পত্তি করেন।

৬—দফার কারনে জেল

৬—দফার কারনে শেখ মুজিবকে সবচেয়ে বেশি কারাগারে বন্দি থাকতে হয়। রমনা থানার ৮০/১৯৬৬ মামলায় ১ দিন (১৮ এপ্রিল ১৯৬৬), সিলেট জেলার নালিশী ১৪১৫/১৯৬৬ মামলায় ৩ দিন (২১Ñ২৩ এপ্রিল ১৯৬৬) এবং ময়মনসিংহ জেলার নালিশী ৪০৯/১৯৬৬ মামলায় ২ দিন (২৪Ñ২৫ এপ্রিল ১৯৬৬) তাকে কারাগারে বন্দি থাকতে হয়। এসকল মামলায় একের পর এক জামিন হয়ে যাওয়ায় সরকার পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমতে শেখ মুজিবকে আটকাদেশ দিয়ে বন্দি করে রাখে।
এরপর ১৯৬৬ সালের ৮ মে মধ্যরাত থেকে একটানা ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাকে আটকে রাখা হয়। ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে তাকে ধানমণ্ডির বাড়িতে পৌছে দেওয়া হয়। সেহিসেবে শেখ মুজিব একাধারে ১০২০ (১৯৬৬ সালে ২৩৭ দিন, ১৯৬৭ সালে ৩৬৫ দিন, ১৯৬৮ সালে ৩৬৫ দিন এবং ১৯৬৯ সালে ৫৩ দিন) দিন কারাগারে বন্দি থাকেন। বলা যেতে পারে, ৬—দফার মাশুল হিসেবেই তাকে ঐতিহাসিক আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়।

লেখকের কৈফিয়তঃ ৬—দফা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভুষিত হওয়ায় তাকে এ লেখায় শেখ মুজিব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

লেখক: মোহাম্মদ মশিউর রহমান; আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট এবং সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যকরি কমিটির সাবেক সদস্য।

তথ্যসূত্র

The Awami League 1949-1971, Shaymoli Ghose, Academia Publications, p. 106
আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮—১৯৭১, মহিউদ্দিন আহমদ, প্রথমা প্রকাশন, পৃ. ২৩৯
কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলা একাডেমি, পৃ. ৩০৯
দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬
দৈনিক ইত্তেফাক, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬
দৈনিক ইত্তেফাক, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬
বঙ্গবন্ধুকে যেমন দেখেছি, শেখ মোস্তফা নূরুল আমীন, চারুলিপি প্রকাশন, পৃ. ১৭
ইতিহাস কথা কয়, তোফায়েল আহমেদ, জার্নিম্যান বুকস, পৃ. ১৭০
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন ও রাজনীতি, প্রথম খণ্ড, মোনায়েম সরকার সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, পৃ. ৩২৫
দৈনিক ইত্তেফাক, ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬
দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ মার্চ ১৯৬৬
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ মার্চ ১৯৬৬
দৈনিক ইত্তেফাক, ২১ মার্চ ১৯৬৬
দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬ মার্চ ১৯৬৬
দৈনিক ইত্তেফাক, ২৮ মার্চ ১৯৬৬
দৈনিক ইত্তেফাক, ২৯ মার্চ ১৯৬৬
দৈনিক আজাদ, ৯ এপ্রিল ১৯৬৬
দৈনিক আজাদ, ১০ এপ্রিল ১৯৬৬
দৈনিক আজাদ, ১১ এপ্রিল ১৯৬৬
দৈনিক পাকিস্তান, ১২ এপ্রিল ১৯৬৬
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ এপ্রিল ১৯৬৬
দৈনিক আজাদ, ১৬ এপ্রিল ১৯৬৬
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ এপ্রিল ১৯৬৬
দৈনিক ইত্তেফাক, ৩০ এপ্রিল ১৯৬৬
দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ মে ১৯৬৬
দৈনিক ইত্তেফাক, ৮ মে ১৯৬৬
দৈনিক পাকিস্তান, ৯ মে ১৯৬৬
দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ এপ্রিল ১৯৬৬
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬
আওয়ামী লীগের ইতিহাস, আবু আল সাঈদ, আগামী প্রকাশনি, পৃ. ১৪৫
আওয়ামী লীগের ইতিহাস, আবু আল সাঈদ, আগামী প্রকাশনি, পৃ. ১৪৯
দৈনিক সংবাদ, ২১ মার্চ ১৯৬৬
ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মাযহারুল ইসলাম, দ্বিতীয় প্রকাশ, আগামী প্রকাশনি, পৃ. ২৭৪