সরকারের কালো টাকা সাদা করার নীতি দুদক আইনের সাথে সাংঘর্ষিক

সরকারের কালো টাকা সাদা করার নীতি দুদক আইনের সাথে সাংঘর্ষিক

আশরাফুল করিম সাগর: আগামী জুলাই মাস থেকে এক বছরের জন্য কালো টাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। নগদ টাকা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে বৈধ বা সাদা করা যাবে। একইভাবে জমি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট কিনেও এলাকাভেদে নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে টাকা সাদা করা যাবে। একেক এলাকার জন্য বর্গমিটার অনুসারে নির্দিষ্ট কর দিতে হবে।

অপর দিকে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ধারা ২৬ এবং ২৭ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ধারা ৮ এর সাথে সরকারের কালো টাকা সাদা করার বিষয়টি সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।

এই সাদা করবার সুযোগ দেয়ার অন্যতম কারন সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি যা এ যাবতকালে এই সুযোগ গ্রহণ করে প্রায় সাতচল্লিশ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। কিন্তু মূল বিষয়টি হচ্ছে সকলেই এই টাকার উৎস দেখাতে পারেন না দেখেই সরকারের দেওয়া এই সুযোগটি গ্রহণ করেন।

কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ধারা ২৬ সহায় সম্পত্তির ঘোষণা –

২৬৷ (১) কমিশন কোন তথ্যের ভিত্তিতে এবং উহার বিবেচনায় প্রয়োজনীয় [অনুসন্ধান] পরিচালনার পর যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, কোন ব্যক্তি, বা তাহার পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তি, বৈধ উৎসের সহিত অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পত্তির দখলে রহিয়াছেন বা মালিকানা অর্জন করিয়াছেন, তাহা হইলে কমিশন, লিখিত আদেশ দ্বারা, উক্ত ব্যক্তিকে কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতিতে দায়-দায়িত্বের বিবরণ দাখিলসহ উক্ত আদেশে নির্ধারিত অন্য যে কোন তথ্য দাখিলের নির্দেশ দিতে পারিবে৷

(২) যদি কোন ব্যক্তি-

(ক) উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত আদেশ প্রাপ্তির পর তদ্‌নুযায়ী লিখিত বিবৃতি বা তথ্য প্রদানে ব্যর্থ হন বা এমন কোন লিখিত বিবৃতি বা তথ্য প্রদান করেন যাহা ভিত্তিহীন বা মিথ্যা বলিয়া মনে করিবার যথার্থ কারণ থাকে, অথবা

(খ) কোন বই, হিসাব, রেকর্ড, ঘোষণা পত্র, রিটার্ণ বা উপ-ধারা (১) এর অধীন কোন দলিল পত্র দাখিল করেন বা এমন কোন বিবৃতি প্রদান করেন যাহা ভিত্তিহীন বা মিথ্যা বলিয়া মনে করিবার যথার্থ কারণ থাকে,

তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি ০৩ (তিন) বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন৷

আরও পড়ুন: ১৫% কর দিয়ে জমি, ফ্ল্যাট ও কালো টাকা সাদা করা যাবে

দুদক আইনের এই ২৬ ধারার উপ-ধারা (১) পরিষ্কার ভাবে বলা হচ্ছে “বৈধ উৎসের সহিত অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পত্তির দখলে রহিয়াছেন বা মালিকানা অর্জন করিয়াছেন”- এই অংশটুকু ব্যাখ্যা করলে পরিষ্কার হওয়া যায় যে যারা সরকারের দেওয়া সুযোগ নিয়ে উৎস বিহীন আয় নির্ধারিত হারে কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করেছেন আয়কর নথিতেও প্রদর্শন করেছেন এই কার্য সম্পাদন পর্যন্ত সরকার বা অধীনস্থ আয়কর বিভাগ সন্তুষ্ট থাকলেও, দুদক আইন অনুযায়ী দুদককে আইনানুযায়ী সন্তুষ্ট করা যাচ্ছে না।

কেননা দুদক আইন অনুযায়ী ঘোষিত সম্পত্তির বৈধ উৎস দেখাতে হবে, কিন্ত যিনি সরকারের ঘোষিত উৎসবিহীন আয়ের সাদা করার সুযোগ নিয়েছিলেন এই জন্যই নিয়েছিলেন যে তাকে সম্পদ অর্জনের উৎস দেখাতে হয়নি।

অপরদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ধারা ২৭ জ্ঞাত আয়ের উৎস বহির্ভূত সম্পত্তির দখল-

২৭৷ (১) কোন ব্যক্তি তাহার নিজ নামে, বা তাহার পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তির নামে, এমন কোন স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির দখলে রহিয়াছেন বা মালিকানা অর্জন করিয়াছেন, যাহা অসাধু উপায়ে অর্জিত হইয়াছে এবং তাহার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সহিত অসংগতিপূর্ণ বলিয়া মনে করিবার যথেষ্ট কারণ রহিয়াছে এবং তিনি উক্তরূপ সম্পত্তি দখল সম্পর্কে আদালতের নিকট বিচারে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা প্রদান করিতে ব্যর্থ হইলে উক্ত ব্যক্তি অনূর্ধ্ব ১০ (দশ) বৎসর এবং অন্যুন ০৩ (তিন) বৎসর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদে কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন, এবং উক্তরূপ সম্পত্তিসমূহ বাজেয়াপ্ত যোগ্য হইবে৷

(২) উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত কোন অপরাধের বিচার চলাকালীন যদি প্রমাণিত হয় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজ নামে, বা তাহার পক্ষে অপর কোন ব্যক্তির নামে, তাহার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সহিত অসঙ্গতিপূর্ণ স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা অর্জন করিয়াছেন বা অনুরূপ সম্পত্তির দখলে রহিয়াছেন, তাহা হইলে আদালত অনুমান করিবে (shall presume) যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি উক্ত অপরাধে দোষী, যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি আদালতে উক্ত অনুমান খণ্ডন (rebut) করিতে না পারেন, এবং কেবল উক্তরূপ অনুমানের উপর ভিত্তি করিয়া প্রদত্ত কোন দণ্ড অবৈধ হইবে না৷

আরও পড়ুন: দেশে খেলাপী ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতকে কার্যকর করার কিছু সুপারিশ

দুদক আইন ২০০৪ এর ২৭ ধরার উপ-ধারা (১) স্পষ্ট বলা হচ্ছে – “এমন কোন স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির দখলে রহিয়াছেন বা মালিকানা অর্জন করিয়াছেন, যাহা অসাধু উপায়ে অর্জিত হইয়াছে এবং তাহার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সহিত অসংগতিপূর্ণ” উল্লেখিত ধারার এই অংশটুকু ব্যাখ্যা করলে বুঝতে পারা যাবে যে যারা অসাধু উপায়ে বা উৎস দেখাতে পারছেন না এবং আয়ের উৎসের সহিত অসংগতিপূর্ণ স্বাভাবিক ভাবেই তারাই কালো টাকা সাদা এবং অপ্রদর্শিত সম্পত্তি সরকারের দেওয়া সুযোগ গ্রহণ করে বৈধ করবেন।

অপরদিকে দুদক যদি কারো অবৈধ সম্পদ এর প্রাথমিক অনুসন্ধান করেন অথবা পরবর্তীতে তদন্ত হয় সেই অভিযুক্ত আয়করদতা যিনি ১৫% হারে কর দিয়ে অবৈধ সম্পদ বৈধ করেছেন তার হিসাব দিতে পারবেন কিন্তু সেই সম্পত্তির কোন বৈধ উৎস দেখাতে পারবেন না এটাই স্বাভাবিক।

সরকার, আয়কর বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, এবং বিচার বিভাগের এই বিষয়ে অনেক বেশি দায়িত্বশীল এবং সুচিন্তিত নীতিমালা হওয়া প্রয়োজন। যাতে সাধারণ মানুষ আইনি জটিলতায় পড়ে সমস্যার নিমজ্জিত না হোন।

লেখক: আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা।