আইনের সংস্পর্শে আসা বা আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত কাউকে শিশু হিসেবে নির্ধারণ করার এখতিয়ার কোনো তদন্ত কর্মকর্তার নেই বলে পর্যবেক্ষণসহ রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
তবে কাউকে শিশু হিসেবে মনে হলে তদন্ত কর্মকর্তা বা প্রতিষ্ঠান তার বয়স নির্ধারণে শিশু আদালতে হাজির করবে এবং সেক্ষেত্রে শিশু আদালত ২০১৩ সালের শিশু আইনের ২১ ধারার বিধান অনুসরণ করে বয়স নির্ধারণ করবে।
হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের দেওয়া এ সংক্রান্ত রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে। হাইকোর্টের গত ১৫ ফেব্রুয়ারির রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপিটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
‘মাওলানা আবদুস সাত্তার বনাম রাষ্ট্র এবং অন্য একজন’ শিরোনামের ফৌজদারি এক আপিল মঞ্জুর করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে এমন নির্দেশনাসহ পাঁচ দফা নিয়মাবলি (গাইডলাইন) দিয়েছেন।
আইনের সংস্পর্শে আসা (অপরাধের শিকার বা সাক্ষী শিশু) কিংবা আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর (অপরাধের যুক্ত শিশু) বয়স নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট বিচারককে এই নিয়মাবলি অনুসরণ করতে বলেছেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টে আবদুস সাত্তারের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম। আরিফুলের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম কে রহমান ও আইনজীবী আরিফ মঈনুদ্দীন চৌধুরী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আবদুল আজিজ মিয়া ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান।
রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, শিশু আইনের ২১ ধারার বিধান অনুযায়ী, কেউ অভিযুক্ত হোক বা না-হোক, কেবল কাউকে শিশু হিসেবে অভিহিত করার অধিকার শুধু শিশু আদালতকে দেওয়া হয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত কোনো শিশুর বয়স নির্ধারণে কোনো শিশুর শিক্ষাগত সনদে উল্লেখিত জন্মতারিখ এবং জন্মমৃত্যু নিবন্ধন আইনের বিধানমতে নিবন্ধিত জন্মসনদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে জন্মসনদ প্রাধান্য পাবে। আর জন্মনিবন্ধনের তারিখ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সনদের জন্মতারিখ ও আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর বাহ্যিক অবয়ব-শারীরিক গঠন আপাতদৃষ্টে সাংঘর্ষিক বলে মনে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি রেজিস্ট্রার ও ছাত্রছাত্রীর হাজিরা খাতা তলব করে মিলিয়ে দেখতে হবে। তা সম্ভব না হলে সরকারি মেডিকেল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে গঠিত বোর্ডের মাধ্যমে বয়স নির্ধারণ করতে হবে।
হাইকোর্টের রায়ে আরও বলা হয়েছে যে, আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত কোনো শিশু বা ব্যক্তিকে যদি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার বিধানমতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির জন্য কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপস্থাপন করা হয়; আর সেক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বয়স নির্ধারণের কোনো অকাট্য বিশ্বাসযোগ্য দলিল উপস্থাপন না করা হয়, তাহলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার বিধানমতে জবানবন্দি লেখার আগে আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর বয়স নির্ধারণে শিশু আইনের বিধান অনুযায়ী উপরিউক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
একই ভাবে শিশু আদালত কিংবা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আইনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িত কোনো শিশুর বয়স নির্ধারণে উপরিউক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করবেন।
নথিপত্র থেকে জানা যায়, জমিজমা নিয়ে বিরোধের সূত্রে মারধর এবং মো. রাকিব হোসেনকে (২৫) হত্যার অভিযোগে মো. আরিফুল ইসলাম ওরফে জিহাদসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পটুয়াখালীর দশমিনা থানায় মামলা হয়। মামলার বাদী নিহত ব্যক্তির বাবা আবদুস সাত্তার।
মামলায় ২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর তদন্ত কর্মকর্তা আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র এবং একজনের ক্ষেত্রে দোষীপত্র দেন। দোষীপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করে বাদীপক্ষ, যা ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ ম্যাজিস্ট্রেট নামঞ্জুর করেন। আরিফুলকে শিশু হিসেবে অভিহিত করে দোষীপত্র গ্রহণ করা হয়। এ আদেশের বিরুদ্ধে পটুয়াখালীর দায়রা জজ আদালতে ফৌজদারি রিভিশন আবেদন করে বাদীপক্ষ। রিভিশন মঞ্জুর করে আরিফুলের বয়স নির্ধারণে আবার তদন্তে দশমিনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
আরিফুলের বয়স নির্ধারণে ফিজিক্যাল ও রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা।
মামলাটি দায়রা মামলা হিসেবে নিবন্ধিত হয়। অভিযোগ গঠনের সময় পটুয়াখালীর দায়রা জজ ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর আরিফুলের বয়স নির্ধারণে মামলার নথি শিশু আদালতে পাঠাতে ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেন।
মামলাটি পাঠানো হলে পটুয়াখালীর শিশু আদালত ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি শুনানির জন্য তারিখ ধার্য করেন। সেদিন আরিফুলের ভর্তি রেজিস্ট্রার ও ছাত্রছাত্রীর হাজিরা খাতা স্কুল থেকে তলবের জন্য বাদীপক্ষ দরখাস্ত করলে তা নামঞ্জুর হয়। এই আদেশের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে হাইকোর্টে আপিল করেন মামলা বাদী আবদুস সাত্তার।
আপিলটি মঞ্জুর করে দেওয়া রায়ে হাইকোর্ট বলেন, পটুয়াখালীর শিশু আদালতের বিচারক প্রতিপক্ষের (আরিফুল) তথা আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর বয়স নির্ধারণে যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, তা ন্যায়সংগত ও আইনানুগ নয়। শিশু আদালতের ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারির আদেশ রদ ও রহিত করা হলো। যদি আদালত মনে করেন, তাহলে প্রতিপক্ষের বয়স পুনর্নির্ধারণে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন।
এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রায়টি হাতে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহফুজুর রহমান।
তিনি বলেন, মামলায় ১৬৪ ধারায় আরিফুল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তার বয়স ১৯ বছর উল্লেখ করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা প্রথম অভিযোগপত্রে শিশু নির্ধারণ করে তার বিরুদ্ধে দোষীপত্র দাখিল করেন, যেখানে তার বয়স সাড়ে ১৫ বছর উল্লেখ করা হয়। বয়সের সঠিকতা নির্ণয়ে আরিফুলের স্কুলের ভর্তির রেজিস্ট্রার ও হাজিরা খাতা তলবের জন্য বাদীপক্ষ শিশু আদালতে আবেদন করে।
তিনি আরও বলেন, আরিফুলের পিইসি, জেএসসি ও এসএসসি সনদে উল্লেখিত জন্মতারিখকে প্রাধান্য দিয়ে আদালত সেই দরখাস্ত নামঞ্জুর করেন। আরিফুলের বয়স ১৮ বছরের নিচে নির্ধারণ করেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে বাদীপক্ষের করা আপিল মঞ্জুর করে হাইকোর্ট রায় দেন। একই সাথে বিচারককে এই নির্দেশনাগুলো মেনে চলতে বলা হয়েছে, যা শিশুর বয়স নির্ধারণে সহায়ক হবে।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আরিফ মঈনুদ্দীন চৌধুরী বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলেও তা এখনো হাতে পাইনি। রায় হাতে পাওয়ার পর আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।