নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বাগত ও অভিনন্দন জানিয়ে বিচার বিভাগের পুনর্গঠন ও সংস্কারের লক্ষ্যে ১২ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে সাবেক বিচারকেরা। তারা মাসদার হোসেন মামলায় আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়ন চেয়েছেন।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে ‘অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ফোরাম’ নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) এই প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ ফিরোজ আলম এই ১২ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। এতে সুপ্রিমকোর্টের বর্তমান রেজিস্ট্রার জেনারেলসহ সকল বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের এবং আইন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আওয়ামী সরকারের সহযোগী বিশেষ করে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব গোলাম সারোয়ার, যুগ্ম সচিব বিকাশ কুমার সাহা ও শেখ গোলাম মাহবুব, মাহাবুবুর রহমান সরকার (বর্তমানে জেলা জজ, নরসিংদী), এ এইচ এম হাবিবুর রহমান জিন্নাহ (সদস্য, যুদ্ধ অপরাধ ট্রাইব্যুনাল), শহিদুল আলম ঝিনুক (তথ্য কমিশনার ও সাবেক আইজিআর)-সহ সংশ্লিষ্ট অন্য সকল কর্মকর্তাকে অবিলম্বে অপসারণ করে সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ প্রদান এবং উক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করার দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত বিচারপতিরা যারা শপথ ভঙ্গ করে, আচরণ বিধি লঙ্ঘন করে বিদায়ী ‘স্বৈরশাসক’কে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন, যাদের কারণে বিচার বিভাগ আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, তাদেরকে অপসারণ করে বিচারের আওতায় আনার কথা বলা হয়।
আপিল বিভাগে কর্মরত থেকে যে সকল বিচারপতি আচরণ বিধি লঙ্ঘন করে শপথ ভঙ্গ করে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানসহ ‘স্বৈরশাসক’কে তাদের অপকর্মে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদেরকেও বিচারের আওতায় আনার দাবি করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সাবেক বিচারকেরা বলেন, ‘আমরা মনে করি বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার দেশ ও জাতির মঙ্গলের জন্য যা করতে ব্যর্থ হয়েছে, সৎ, সাহসী, ও নিরপেক্ষ স্বনামধন্য ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা করতে সক্ষম হবেন। এবং জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।’
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মাসদার হোসেন, আ রহমান, ফিরোজ আলম, জাহাঙ্গীর আলম, আবুল হোসেন খান, বিচারক আবুল হোসেন খন্দকার, মুসতাক আহমেদ, স ম আব্দুর রব প্রমুখ।
বিচারকদের ১২ দফা প্রস্তাবনা নিম্নরূপ –
১। বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত ও দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনের সংশোধন আনয়ন।
২। বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচারকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ প্রদান।
৩। বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতিসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার নীতিমালা প্রনয়ণ ও অন্যান্য কার্যাদি সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় গঠন।
৪। মাসদার হোসেন মামলায় প্রদত্ত বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়নকরণ।
৫। সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রনয়ণকরণ।
৬। যে সকল বিচারক আচরণ বিধি লঙ্ঘন করে স্বৈরাচারী সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে তাদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য প্রকাশ্যে সরকারকে সমর্থন করে ন্যায়বিচারের পরিপন্থী কাজ করেছে, জামিন যোগ্য মামলায় জামিন না দিয়ে শত সহস্র নিষ্পাপ মানুষকে কারাগারে পাঠিয়েছে, রিমান্ড আদেশ দিয়ে হয়রানী ও নির্যাতনের সুযোগ করে দিয়েছে এবং ফরমায়েশী রায় দিয়ে শাস্তি দিয়েছে তাদেরকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ।
৭। বিচারিক আদালতের সকল স্তরে গুরত্বপূর্ণ পদে থাকা ন্যায়বিচার পরিপন্থী স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষে কাজ করা বিচারকদের বদলী করে তদস্থলে সৎ ও নিরপেক্ষ বিচারকদের পদায়ন করণ।
৯। চুক্তিভিক্তিক নিয়োগকৃত সকল বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগ বাতিল করে তদস্থলে যোগ্য ও নিরপেক্ষ অবসর প্রাপ্ত বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রদান করণ।
১১। ভবিষ্যৎ স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা বিলুপ্তির এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সংবিধানের আমূল সংস্করণ আনয়নের দাবি জানাচ্ছি।
১২। অবসরপ্রাপ্ত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা দেশ ও জাতির এহেন ক্রান্তিলগ্নে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও প্রধান বিচারপতি মহোদয়কে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করতে ইচ্ছুক। বর্তমান সরকার যদি প্রয়োজন মনে করেন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারকগণের প্রতি যদি কোনো দায়িত্ব অর্পণ করেন তবে তারা উক্ত দায়িত্ব সমূহ আন্তরিকতার সাথে সুষ্ঠুভাবে সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করতে সম্মত আছেন।