মো: সামিউল আলম: কোন সন্দেহ ছাড়াই বলা যায় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ সময়টা পার করছে এখন। গত ৫ আগষ্ট ক্ষমতাসীন দলের পদত্যাগের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক পট পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে এবং রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শুরু হয়ে গেছে। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রাষ্ট্রের প্রধান আইন মানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন করা। কারণ,অতীতে প্রতিটা রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থে সংবিধান সংশোধন করে এতো বাজে অবস্থা করেছে যে রাষ্ট্র সংস্কার করতে সবার আগে সংবিধানে হাত দিতে হবে।
সংবিধান সংশোধন কোন পদ্ধতিতে?
আমরা জানি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাংবিধানিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকার নয়। সুতরাং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলেই সংবিধান সংশোধন করতে পারবে না। কোন নির্বাচিত সরকার ছাড়া কেউ সংবিধান পরিবর্তন করতে পারেনা। তাহলে উপায় কি? উপায় হচ্ছে, রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি করা। যেহেতু, দেশে একটা ক্রান্তীকালীন সময় যাচ্ছে এবং গণঅভ্যুত্থান এর মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন হয়েছে তাই দেশের সকল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটা রাজনৈতিক ঐকমত্য সৃষ্টি করার মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তন করা যায়। যেমনটা হয়েছিলো ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকার পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সৃষ্টির মাধ্যমে। সংবিধানে কি কি পরিবর্তন দরকার সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো-
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা
একটা সময় আমাদের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিলো। কিন্তু, ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করা হয়েছে। পরবর্তীতে এটার বাজে দিক আমরা দেখেছি ২০১৪, ২০১৮ আর ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে। এটা নিশ্চিত যে দলীয় সরকারের অধীনে কোন সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারেনা। সুতরাং, জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা খুবই জরুরি।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস
আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর উপর এতো ক্ষমতা ন্যস্ত করা আছে যে তিনি খুব সহজেই স্বৈরাচারি হয়ে যেতে পারেন। তাছাড়াও, কেউ যদি দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকেন তাহলে তার মাঝে স্বৈরাচারি মনোভাব জাগ্রত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার, অনেক সময় প্রধানমন্ত্রী যেই দল থেকে নির্বাচিত তিনি আবার সেই দলেরও প্রধান হিসেবে কাজ করেন। সুতরাং, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তার নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোতে দলীয় প্রভাব থেকে যায়।এক্ষেত্রে, ক্ষমতার ভারসাম্য নীতি (Doctrine of Check & Balance) প্রয়োগ করা যেতে পারে।এবং,কোন একজন ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না এই বিধান অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি
রাষ্ট্রপতি যে সকল সিদ্ধান্ত নেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে নেন। এইক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ কম। তাই ক্ষমতার ভারসাম্য নীতির প্রতিফলন ঘটিয়ে রাষ্ট্রপতিকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ নিশ্চিত করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনা
অনুচ্ছেদ ৭০ এর বিধান যেটি আমাদের কাছে ফ্লোর ক্রসিং নামে পরিচিত। নিজের দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিতে না পারা আমাদের সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদের বাক স্বাধীনতার পরিপন্থি। ৭০ অনুচ্ছেদের প্রয়োগ ঘটিয়ে অনেক সেচ্ছাচারি আইন ও সিদ্ধান্ত খুব সহজেই সংসদে পাস করিয়ে নেওয়া যায়। ১৯৭২ সালে এই বিধানটি রাখার পক্ষে যুক্তি ছিলো যে সংসদ সদস্যরা টাকার কাছে বিক্রি হয়ে একটি অস্থিতিশীল সংসদ তৈরি করতে পারে। কিন্তু,বর্তমান সময়কে সংবিধান প্রনয়নের সময়কালের সাথে তুলনা করলে হবেনা।তাই চিন্তা বিবেক ও বাক স্বাধীনতার রক্ষার্থে এই বিধানটি পরিবর্তন অতীব জরুরি।
কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কমানো ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা
আমাদের দেশে ১৮ কোটির বেশি জনগণ বাস করে। এতো জনসংখ্যার জন্য একটা কেন্দ্রীয় সরকারের শাষণ খুবই দুরুহ বিষয়। অন্যদিকে, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করলে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন নিশ্চিত করা সহজ হবে।
স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে গণতান্ত্রিক করা
নির্বাচন কমিশন, কমিশন, দুদক, মানবাধিকার কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, এটর্নি জেনারেল অফিস, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক অফিসগুলোকে গণতান্ত্রিক উপায়ে কাজ করার সুযোগ দিলে সরকারকে তার কাজের জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আনা সহজ হবে। সুতরাং, উপরে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে জবাবদিহি নীতি (Principle of Accountably) চর্চা খুবই জরুরি।
ন্যায়পালের বিধান কার্যকর
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ৭৭ নং অনুচ্ছেদে ন্যায়পাল সম্পর্কে বলা হয়েছে। পার্লামেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত কমিশনার বা কর্মকর্তাকে ন্যায়পাল বলে। তিনি সরকার, মন্ত্রণালয়, সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত করেন। আবার, ন্যায়পাল আইন ১৯৮০ নামে একটি আইনও রয়েছে। কিন্তু,এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে কাউকে ন্যায়পাল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সুতরাং, সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে এই বিধানের কার্যকর করা অতীব জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অংশের একটি হলো বিচার বিভাগ।গণতন্ত্র,ন্যায়বিচার, মানবাধিকার রক্ষায় বিচার বিভাগকে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন রাখা খুবই জরুরি। কিন্তু,প্রায়ই দেখা যায় বিচার বিভাগে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থাকে। যেমন :কিছুদিন আগেই কোটা সংস্কারের বিষয়টি যেটি কিনা ছিল একটি রাষ্ট্রের পলিসি মেকিং এর বিষয় সেখানে বিচার বিভাগকে চাপ দিয়ে আপিল বিভাগ থেকে এই বিষয়ে রায় দেওয়ানো হলো। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ Doctrine of Political Question এর বিষয় ছিলো। কিন্তু,এই বিষয়ে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করা হয়েছে।
এছাড়াও, প্রধান বিচারপতি-সহ আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগের মানদন্ড ঠিক করা এবং কোন দলীয় বিবেচনায় বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া বন্ধ করলেই বিচার বিভাগ স্বাধীন হবে।অন্যদিকে,প্রধান বিচারপতির হাতেও প্রচুর ক্ষমতা থাকে। যেমন:নিজের ইচ্ছামতো বেঞ্চ গঠন করা একটি বিষয়। সুতরাং,প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা কমিয়ে আনাও বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সহায়তা করবে।একইসাথে,নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষভাবে কাজ করা এবং দলীয় প্রভাব মুক্ত করা খুবই জরুরি।
উপসংহার
সংবিধান একটি রাষ্ট্রের ধ্রুবতারা ও ভবিষ্যতের রুপরেখা। তাই রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য আমাদের প্রয়োজন একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী একটি সংবিধান যেটাতে জনগণের ম মতামত প্রতিফলিত হবে এবং তাদের মালিকানা থাকবে।
লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।