বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের ইতিহাস, স্বাধীনতা ও বাস্তবতা
মো. তাওহিদ হোসেন

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে আইন বিষয় পাঠ্যভুক্ত করা জরুরী

Ignorantia juris non excusat” ল্যাটিন এ ম্যাক্সিমটির ইংরেজি অর্থ করলে দাঁড়ায় Ignorance of the law is no excuse অর্থাৎ আইনের অজ্ঞতা কোন অজুহাত নয় অথবা সহজ করে বিশ্লেষণ করলে বলা যায় আইন না জানা কোন অজুহাত হতে পারে না। আরো সহজ করে বললে বিষয়টি এমন দাঁড়ায়, একজন ব্যক্তি অপরাধ করার পর আদালত ঐ ব্যক্তিকে যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে  সাজা দিলে ঐ ব্যক্তি যদি আদালতে বলে আমি আমার কাজ অর্থাৎ অপরাধ বিষয়ে অবগত নই, আমার এই কাজ যে অপরাধ সেটি আমি জানিনা সেক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি তার অপরাধ থেকে, সাজা থেকে রেহাই পাবে না।

যেকোন অপরাধের বিচারকালে আদালত ধরে নেয় যে দেশের সকল নাগরিক দেশের প্রচলিত আইন বিষয়ে অবগত অথচ অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বাস্তবিক সত্য এটাই আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষ আইন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও ধারণা রাখে না এমনকি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আইন বিষয় অন্তর্ভুক্ত নয়।

আরও পড়ুন: সাবেক ডিবিপ্রধান হারুনের ব্যাংক হিসাব জব্দ

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তিনটি স্তর রয়েছে-প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা স্তর। উচ্চ শিক্ষা স্তরে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলেও বৃহৎ অংশের সে সুযোগ হয় না বা অন্য বিষয়ে পড়ার কারণে আইন বিষয়ে পড়া হয় না। ফলে রাষ্ট্রের  সিংহভাগ শিক্ষার্থী আইন বিষয়ে সম্যক ধারণা রাখে না।  মাধ্যমিক স্তরে একজন শিক্ষার্থীকে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, কম্পিউটার, চারুকলা, শারীরিক শিক্ষা, ক্যারিয়ার শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে পড়ানো হয়।

অথচ আইনের প্রাথমিক বিষয়গুলো ন্যূনতম অংশেও পড়ানো হয় না। পড়ানো হয় না বললে ভুল হবে আইনের খুবই বেসিক বিষয়ও  একক পাঠ্য বই আকারে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রকাশ করা হয় না এমনকি বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় নামে যে বইটি আছে সেখানেও আইনের প্রাথমিক বিষয়গুলো সংযোজিত করা হয় না। বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে সরকার ও রাজনীতি, প্রশাসনিক কাঠামো, আইনের সংজ্ঞা, আইন ও নৈতিকতার পার্থক্য ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ থাকলেও আইনের শাসনের বিস্তৃত ধারণা, সংবিধানের ৩য় ভাগে ১৮ টি  মৌলিক অধিকারের বিস্তৃত ধারণা ফৌজদারি ও দেওয়ানী আইন বিষয়ে ন্যূনতম ধারণা না থাকা বড়ই হতাশাব্যাঞ্জক।

আরও পড়ুন: বিচার ব্যবস্থা সংস্কারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার যা হতে পারে

একটি রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে – আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ। রাষ্ট্রের এই তিনটি অঙ্গই রাষ্ট্র  পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই তিনটি অঙ্গের মধ্যে সাম্যভিত্তিক, সামাজিক ন্যায় বিচার নিশ্চিতকরণে বিচার বিভাগের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। কারণ একজন বিজ্ঞ আইনজ্ঞ যদি আইন বিভাগে তথা সংসদে বসে তাহলে তার কাছে থেকে রাষ্ট্রের এবং জনগণের কল্যাণের জন্য যেমন আইন তৈরি করে আইন বিভাগ ভূমিকা রাখবে, একইভাবে নির্বাহী বিভাগ আইন বিভাগের বানানো আইন অনুসারে বিচার বিভাগের আদেশের মাধ্যমে সেই আইনের প্রয়োগ ঘটাবে।

অথচ বাংলাদেশে যারা আইন তৈরি করছে এবং আইনের প্রয়োগ করছে তাদের ন্যূনতম আইনের জ্ঞান না থাকার জন্য দেশে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হচ্ছে না। অনেক মামলায় দেখা যায় নির্বাহী বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তার আইন বিষয়ে সম্যক জ্ঞান না থাকার জন্য মামলার গুরুত্ব নষ্ট হয়ে যায় ফলে বিচারপ্রার্থী ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয় যার দরুণ সমাজে অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা আরো বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নতুন কমিটি ঘোষণা

একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সবাইকে আইন বিষয়ে পণ্ডিত হতে হবে বিষয়টি এমন না কিন্তু নিজের নাগরিক অধিকার আদায় ও রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালনের জন্য ন্যূনতম আইন বিষয়ে যে জ্ঞান রাখতে হবে সে বিষয়টি অত্যাবশ্যকীয়ভাবে নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষের আইন বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান না থাকার জন্য অনেক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সমাজে এবং রাষ্ট্রে চলতে পদে পদে বিড়ম্বনার শিকার হয়।

তাই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে  অধিকার আদায় ও কর্তব্য পালন করে স্বাধীন ও নিরাপদভাবে বেঁচে থাকার জন্য আইন বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান বা ধারণা রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ আর এর জন্যে মাধ্যমিক পর্যায় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানের পাশাপাশি আইন বিষয়ও পাঠ্য এবং সিলেবাসভুক্ত করা উচিৎ শুধু তাই নয় শ্রেণিকক্ষে তার যথাযথ শিখন ও প্রয়োগের জন্য আইন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের শিক্ষক নিবন্ধন এবং বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া জরুরী।

সবশেষে একটি কথা, একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রব্যবস্থা, গণতন্ত্র, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, আইনের শাসন নিশ্চিতকরণ কেমন হবে সে বিষয়টি নির্ভর করে ঐ দেশের মানুষ কতটা আইন বিষয়ে সচেতন। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে বাংলাদেশে অনেক কালো আইন প্রণয়ন হয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে তবে বর্তমান বাংলাদেশ যেহেতু আমাদের জেন জি’র বাংলাদেশ তাই এই বাংলাদেশকে  সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আইন বিষয়ে সকল নাগরিকদের সম্যক ধারণা রেখে রাষ্ট্রগঠনে মনোনিবেশ করতে হবে আর এক্ষেত্রে বর্তমান সরকার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে আইন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক: এম. তাওহিদ হোসেন; শিক্ষানবিশ আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, সিরাজগঞ্জ।