সিরাজ প্রামাণিক: আসামীর বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা হয়েছে কিন্তু আসামী পলাতক কিংবা বিদেশে আছেন কিংবা মামলা সম্পর্কে জানতেন না—তাহলে আসামীর অনুপস্থিতেই মামলার বিচারিক কাজ শেষ হয়ে যাবে। যখন আসামিপক্ষ গাঢাকা দেয় এবং আদালত তাকে আদালতের সামনে হাজির করতে ব্যর্থ হয়, তখন তার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে থাকার কোনো প্রয়োজন পড়ে না বরং তার অনুপস্থিতিতেই বিচারকাজ শুরু হয়ে যায়। বিচারকাজে আদালতের সামনে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের যে সুযোগ এবং অধিকার আসামিপক্ষ পেয়ে থাকে, সেই সুযোগ যদি আসামি গ্রহণ না করে এবং আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ অমান্য করে লুকিয়ে থাকে, সে অবস্থায় ওই আসামির অনুপস্থিতিতেই বিচারকাজ সম্পন্ন হয়।
পলাতক আসামীর বিরুদ্ধে কোন প্রক্রিয়ায় বিচারকার্য অনুষ্ঠিত হবে সে সম্পর্কে ফৌজদারী কর্যিবিধির ৩৩৯ খ নামের নতুন একটি ধারা সন্নিবেশিত আছে। ওই ধারায় বলা হয়েছে, আসামিকে আদালতে হাজির করার যৌক্তিক প্রচেষ্টা চালানোর পরও যদি তাকে হাজির করা সম্ভব না হয়, তখন তার অনুপস্থিতিতেই বিচারকাজ চলবে।
আরও পড়ুন: নারীর গর্ভপাত বনাম অনাগত শিশুর জীবনের অধিকার
প্রথমত, ফৌজদারি কার্যবিধির ৮৭ ধারা অনুসারে লুকিয়ে থাকা আসামির উদ্দেশে একটি বিশেষ ঘোষণা জারি করতে হবে। আদালত যখন দেখবে যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর থেকে আসামি লুকিয়ে আছে এবং গ্রেপ্তার এড়াতে চাচ্ছে, তখন আদালত ওই আসামির উদ্দেশে বিশেষ একটি লিখিত ঘোষণা জারি করবে, যেখানে আসামিকে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে আদালতের সামনে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেয়া থাকবে। লিখিত এ আদেশ আসামির আবাসিক অঞ্চলের কোনো একটি জায়গায় পড়ে শোনানো হবে। একই সঙ্গে লিখিত আদেশটি আসামি যেখানে বসবাস করতে পারে, সেখানে সাঁটিয়ে দিতে হবে। আদালতের একটি সুস্পষ্ট স্থানেও একই আদেশ লাগিয়ে রাখতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ৮৭ ধারার অধীনে এ ধরনের লিখিত আদেশ রুজু করার পর যে কোনো সময় আদালত ইচ্ছা করলে ৮৮ ধারার অধীনে পালিয়ে থাকা আসামির স্থাবর—অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করতে পারবে।
তৃতীয়ত, এতকিছুর পরও যদি পালিয়ে থাকা আসামি আদালতের সামনে হাজির না হয়, সে ক্ষেত্রে আদালত দুটি বহুলপ্রচারিত বাংলা সংবাদপত্রে আসামির উদ্দেশে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে এই মর্মে আদেশ প্রচার করবেন, উল্লিখিত সময়সীমার মধ্যে যদি আসামি আদালতের সামনে হাজির না হয়, সে ক্ষেত্রে তার অনুপস্থিতিই বিচারকাজ শুরু হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: বিচার বিভাগ সংস্কার প্রসঙ্গ মামলাজট
এত কিছুর পরও যদি পালিয়ে থাকা আসামি আদালতের সামনে হাজির না হয়, সে ক্ষেত্রে আদালত তার অনুপস্থিতিতেই বিচারকাজ সম্পন্ন করবে। তবে আসামি যদি একটিবারের জন্যও বিচারকাজ শুরু হওয়ার আগে আদালতের সামনে উপস্থিত হয়ে থাকে কিংবা আদালতে উপস্থিত হয়ে জামিন নিয়ে থাকে এবং পরে আদালতের সামনে উপস্থিত হওয়া থেকে বিরত থাকে, সে ক্ষেত্রে উপরোল্লিখিত এত্তসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
আদালতের আদেশ বারবার লঙ্ঘন করার পর আদালত যখন আসামির অনুপস্থিতেই বিচারকাজ শুরু করবে, তখন সেই মামলায় ওই আসামির পক্ষে রায়ে সাজা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশী থাকে। তবে টেনশনের কোন কারণ নেই। আসামী দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পরও আপিল করার সুযোগ আছে। বিচারালয়ে আসামি পক্ষ এবং তার সাক্ষীরা উপস্থিত হয়ে নিজেদের আত্মপক্ষ সমর্থন করবে। তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ খণ্ডন করার চেষ্টা করবে। কারণ এ প্রক্রিয়ার লঙ্ঘন করা হলে বিচারকাজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। কাজেই আসামীর অনুপস্থিতেই যদি বিচারকাজ সম্পন্ন হয় তাহলে আসামী আপিল করে জামিন ও সাজা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ইমেইল: seraj.pramanik@gmail.com