সিরাজ প্রামাণিক: আপনার স্বামী দীর্ঘদিন বিদেশে আছেন। আপনি দেশে আছেন। আপনাকে কিংবা আপনার সন্তানদের খোঁজ-খবর কিংবা ভরণপোষণ দেন না। উল্টো করে আপনার উপর নানারকম অপবাদ লেপন করছে। পরকীয়ার কথা বলে স্বামীর পরিবারের পক্ষ থেকে স্বামীর কাছে নানারকম কানভাঙানী দিচ্ছে। এমতাবস্থায় আপনি বিদেশে থাকা ওই স্বামীর সাথে ঘর সংসার করতে চান না, তালাক দিতে চান। হ্যাঁ, আপনি দেশে বসেই বিদেশে থাকা ওই স্বামীকে তালাক দিতে পারেন এবং অন্যত্র বিয়েও করতে পারবেন। কিভাবে এ কাজটি করবেন, তালাক প্রদানের কতদিন পর আপনি অন্যত্র বিয়ে করতে পারবেন, সেই বিয়ের নিয়মাবলী কি, এর জন্য কোথায় যেতে হবে, কত টাকা খরচ হবে, কোন আইনী ঝামেলা হবে কি—না, স্বামীর পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা মোকদ্দমা করতে পারবেন কি—না—সেসব বিষয়ে বিস্তারিত রয়েছে এ নিবন্ধে।
বিয়ের কাবিননামা বা নিকাহনামার ১৮ নং কলামের ক্ষমতা বলে স্ত্রী হিসেবে বিদেশে থাকা স্বামীকে তালাক দিতে পারবেন। কাবিননামার এ ক্ষমতা বলে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব পালনে অপারগতার কারণে স্ত্রী নিজ নফসের প্রতি তালাকের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন এ বিষয়ে ৯ ডিএলআর ৪৫৫ পৃষ্ঠায় উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে। এক্ষেত্রে যেহেতু স্ত্রী তালাক দিচ্ছেন তাই তালাক সংক্রান্ত নোটিশ চেয়ারম্যানের কাছে এবং এর কপি স্বামীর কাছে পাঠাতে হবে।
আরও পড়ুন: বিচার বিভাগ সংস্কার প্রসঙ্গ মামলাজট
এখানে জানিয়ে রাখি যে, এ সংক্রান্ত তালাক আপনি ঘরে বসেই দিতে পারেন। এর জন্য কোনো কাগজপত্রেরও দরকার নেই। আপনি তালাক প্রদানে একটি নোটিশ তৈরী করুন। কী কী কারণে ও কেন স্বামীকে তালাক দিতে চান—কথাগুলো নোটিশ আকারে লিখুন। স্ত্রীর দায়িত্ব এ সংক্রান্ত তালাক ঘোষণার পর স্বামী বিদেশে যেখানে অবস্থান করছেন সেই ঠিকানায় তালাকের নোটিশ পাঠিয়ে দেয়া। যদি স্বামীর বিদেশে চিঠি পাঠানোর ঠিকানা নাই জানুন, তাতেও সমস্যা নেই। স্বামীর দেশের স্থায়ী ঠিকানায় তালাকের নোটিশ পাঠিয়ে দিন। সেইসাথে স্বামীর পিতা—মাতা কিংবা তার অনুপস্থিততে দেশের কোন অভিভাবকের ঠিকানাতেও নোটিশের একটি কপি পাঠিয়ে তালাক সম্পর্কিত বিষয় জানান দিতে পারেন।
আর আপনার স্বামীর এলাকার চেয়ারম্যানকে নোটিশ তো দিতেই হবে। এখানে চেয়ারম্যান বলতে আপনার স্বামীর স্থায়ী ঠিকানা যদি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে হয় তাহলে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নিকট, পৌরসভা হলে পৌরসভার মেয়র এবং সিটি কর্পোরেশন হলে সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে নোটিশ দিতে হবে। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তালাকের কয়টি নোটিশ দিতে হয়। আইন অনুযায়ী তালাকের একটি নোটিশই দিতে হয়। এখন জানার বিষয় তালাকের নোটিশটি কত সময়ের মধ্যে পাঠাতে হবে। আইনে বলা আছে তালাক দেয়ার পর যথাশীঘ্রই সম্ভব তালাকের নোটিশ পাঠাতে হবে। আবার আপোষ মীমাংসা হয়ে গেলে যিনি তালাক দিয়েছেন, নব্বই দিনের মধ্যে তিনি তালাক নোটিশ প্রত্যাহার করলে তালাক আর কার্যকর হবে না।
আরও পড়ুন: মেধাভিত্তিক সরকারি আইন কর্মকর্তা নিয়োগে স্বাধীন প্রসিকিউশন সার্ভিস কমিশন জরুরি
আপনাকে জেনে রাখতে হবে যে, চেয়ারম্যান/মেয়র মহোদয় কর্তৃক কোন নোটিশ পাঠানো কিংবা শালিসী পরিষদ গঠন করুক বা না করুক আপনার নোটিশ পাঠানো এবং ৯০ দিন অতিক্রান্ত হলেই তালাক কার্যকর হয়ে যাবে। এরপর আপনার পছন্দমতো কাউকে বিয়ে করে ঘর সংসার করতে পারবেন। আইনে কোথাও বাঁধা নেই। এতে বিদেশ থাকা স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনরুপ মামলা মোকদ্দমা করে অন্যায় ফায়দা হাসিলেরও কোন সুযোগ নেই। কারণ স্ত্রীর বিরুদ্ধে আইনগতভাবে স্বামীর সম্পদ চুরি মামলা হওয়ার সুযোগ নেই। অনেকে জানতে চান, স্বামীর পরিবারের পক্ষ থেকে টাকা পয়সা আত্মসাতের মামলা করবে কি—না। আগেই বলেছি স্ত্রীর বিরুদ্ধে এ সুযোগ নেই। উল্লেখ্য, আপনি তালাক দিলেও স্বামীর কাছ থেকে আপনি দেনমোহর আদায় করতে পারবেন। কিন্তু স্বামী বিদেশে থেকে আপনার ভরণ—পোষণের জন্য এ্যাকাউন্টে টাকা—পয়সা পাঠিয়েছে, সেগুলো আপনার কাছ থেকে আইনগতভাবে আদায় করতে পারবেন না। তবে সন্তানাদি আপনার কাছে থাকলে তাদের ভরণপোষণ দিতে ওই তালাকপ্রাপ্ত স্বামী বাধ্য।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ইমেইল:seraj.pramanik@gmail.com