অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস বেতন স্কেলে অন্তর্ভূক্তিসহ নিয়োগবিধি সংশোধনের দাবীতে সংবাদ সম্মেলেন করেছেন বাংলাদেশ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন।
রাজধানীর পুরান ঢাকার জনসন রোডস্থ একটি রেস্তরাঁয় শনিবার (২৪ আগস্ট) এ সংবাদ সম্মেলন করেন তারা। এসময় উপস্থিত ছিলেন সভাপতি রেজোয়ান খন্দকার, সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন দিদার, সাংগঠনিক সম্পাদক তারিক আহাম্মেদ রিংকুসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
সংবাদ সম্মেলেন শুরুতেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত অগণিত শহীদদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন এবং তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। আহত ছাত্র-জনতার আশু সুস্থতা কামনাসহ সু-চিকিৎসার দাবী জানান।
একইসাথে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে বৃষ্টি ও উজান থেকে ধেয়ে আসা পাহাড়ী ঢলের কারণে সৃষ্ট আকষ্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধার তৎপরতাসহ সার্বিক সহযোগিতার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
নেতৃবৃন্দ বলেন, তারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর বিচার বিভাগাধীন অধস্তন আদালতের কর্মচারী। বিচারিক কাজের সাথে বিচারক ও সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী, বাংলাদেশ পুলিশ এবং আইনজীবীদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু, অধস্তন আদালতের কার্যক্রম বিচারক ও সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমেই সম্পাদিত হয়।
আপনারা জানেন, ক্রিমিনাল রুলস এন্ড অর্ডারস, সিভিল রুলস এন্ড অর্ডারস এর আলোকে বিচারকের নির্দেশনা মোতাবেক অধস্তন আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ বিচার কাজে অত্যাবশ্যকীয় ভূমিকা পালন করে থাকেন।
আরও পড়ুন: বগুড়ায় বিচারকের উপর হামলাকারীকে গণধোলাই
বিচারক ও সহায়ক কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলী ও পদোন্নতি দিয়ে থাকেন আইন মন্ত্রণালয় এবং অধস্তন আদালতের সহায়ক কর্মচারীদের নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রদান করে থাকেন জেলা জজ। সহায়ক কর্মচারীদের আন্তজেলা বদলি করেন হাইকোর্ট বিভাগ।
আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-স্কেল এর আলোকে বিচারকদের বেতন-ভাতাদি প্রদান করা হলেও আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ বিচারকদের সাথে একই দপ্তরে কর্ম করেও জনপ্রশাসনের বেতন-ভাতাদি পান। বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পর বিচার বিভাগের জন্য ৬টি গ্রেড রেখে পৃথক পে-স্কেলসহ নিয়োগ বিধিমালা করা হলেও সহায়ক কর্মচারীদেরকে উক্ত পে-স্কেলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
বিচারকদের জন্য বিচারিক ভাতা, চৌকি ভাতা, দেওয়ানি আদালতের অবকাশকালীন ছুটি (ডিসেম্বর মাস) ফৌজদারি আদালতে দায়িত্ব পালনের জন্য এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অবকাশ ভাতা থাকলেও বিচার সহায়ক কর্মচারীদেরকে উক্তরূপ কোন ভাতা দেয়া হয়না।
এক কথায় বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর বিচারকদের জন্য যে সকল সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়েছে, বিপরীতে বঞ্চিত করা হয়েছে সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে। এমনকি মাঠ পর্যায়ে সমন জারির সাথে সম্পৃক্ত জারীকারকদের কোন ধরনের টিএ/ডিএ প্রদান করা হয় না। এমনইভাবে একই দপ্তরে কর্ম করে নানাবিধ বৈষম্যের যাঁতাকলে নিম্ন আদালতের কর্মচারীরা।
২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর থেকেই বিচার বিভাগের একটা অংশ বৈষম্য ও বঞ্চনায় গুমরে কাঁদছে। অধস্তন আদালতের কর্মচারীরা বিচার বিভাগের সহায়ক কর্মচারী হিসেবে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস বেতন স্কেলে অন্তর্ভূক্তিসহ নিয়োগবিধি সংশোধনের দাবীতে সংগঠিত হয়ে দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন করে আসছে।
সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন না করলে আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার ফিরে পেতাম না। সারজিস আলমরাই এই পথ দেখিয়েছে, এজন্য ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তারা চির কৃতজ্ঞ। তারা অতীতে বৈষম্য নিয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রত্যেকের দাঁড়ে দাঁড়ে গিয়েও বারবার আশাহত হয়ে ফিরেছেন।
আরও পড়ুন: আদালতে আসামি পক্ষে আইনজীবী না থাকলে লিগ্যাল এইড থেকে আইনজীবী নিয়োগের নির্দেশ
অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের দাবী (১) অধস্তন আদালতের কর্মচারীদেরকে বিচার বিভাগের সহায়ক কর্মচারী হিসাবে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস বেতন স্কেল এর আলোকে বেতন ভাতা প্রদান করতে হবে। (২) ব্লক পদ বিলুপ্ত করে যুগোপযোগী পদ সৃজনপূর্বক যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতির সুযোগ রেখে অভিন্ন নিয়োগ বিধি প্রণয়ন করতে হবে।
বিচার বিভাগের সহায়ক কর্মচারীদের পদোন্নতি সুবিধা খুবই সীমিত। এমনকি, অনেক পদের পদোন্নতির সুযোগ নেই। যে সকল পদের পদোন্নতির সুযোগ আছে সেখানেও রয়েছে অনেক প্রতিবন্ধকতা। অন্যান্য দপ্তরে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির জন্য যেখানে ফিডারপদে ৫ থেকে ৭ বছরের চাকরি অভিজ্ঞতায় পদোন্নতির সুযোগ আছে সেখানে অধঃস্তন আদালতের কর্মচারীদেরকে উক্ত পদের জন্য ২০/২২ বছর অপেক্ষা করতে হয়। অনেক কর্মচারীকে পদোন্নতি ছাড়াই একই পদে থেকে চাকরি থেকে অবসর নিতে হয়।
আদালতের কর্মচারীরা বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সমাজে বিবেচিত হন। কিন্তু বর্তমানে বেশির ভাগ কর্মচারী আর্থিকভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এক সময় আদালতের উচ্চমান সহকারী (সেরেস্তাদার) এমন মর্যাদা পেতেন যে তিনি অফিসার্স ক্লাবের সদস্য হতে পারতেন। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ের জাতীয় বেতন স্কেল পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্তমানে কিছুসংখ্যক দ্বিতীয় শ্রেণির পদ যেমন- উপ-সহকারী প্রকৌশলী, অডিটর, সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল সেরেস্তাদারের নিচে ছিল। যা বর্তমানে সেরেস্তাদারের বেতন স্কেলের দ্বিগুণ। অপরদিকে বিচার বিভাগের কর্মচারীদের পদোন্নতির যেটুকু ব্যবস্থা রয়েছে, তার চেয়ে ব্লক পদের সংখ্যাই বেশি।
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বিচার বিভাগের ডিজিটালাইজেশনের কার্যক্রম চলমান থাকলেও প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য জনবল অপ্রতুল। বিচার বিভাগীয় বাতায়ন ও মামলার কার্যতালিকার কার্যক্রম দৈনন্দিন হালনাগাদ করতে প্রযুক্তি নির্ভর জনবল আবশ্যক। তা না হলে ডিজিটাইজেশনের এই উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়বে।
আরও পড়ুন: বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের শৃঙ্খলাবিধি চ্যালেঞ্জ করে রিট
পদোন্নতির ধারা উন্মোচন সহ নতুন পদ সৃজন না করায় অধিকাংশ কর্মচারীদের পদোন্নতির পদ রুদ্ধ। আবার যাদের পদোন্নতির সুযোগ আছে তাদের ২০ থেকে ২২ বছর চাকুরীর পর যোগ্যতা অর্জিত হয়। পদোন্নতিযোগ্য পদ সীমিত হওয়ায়, সেখানে অধিকাংশই পদোন্নতি বঞ্চিত থাকতে হয়। অনেকেরই পদোন্নতির আগে চাকরির বয়সসীমা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আক্ষেপ ও হতাশা নিয়ে বৈষম্যের শিকার অধস্তন আদালতের কর্মচারীরা অবসরে যাচ্ছেন।
নিয়োগ বিধি দ্রুততম সময়ে সংশোধনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও নিয়োগ বাণিজ্যসহ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলায় ব্যস্ত আইন মন্ত্রণালয় দীর্ঘ ৯ বছরেও অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের নিয়োগ বিধি সংশোধনের কাজ চূড়ান্ত করেনি।
মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলে শুধু আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন, বাস্তবে কোন অগ্রগতি হয়নি। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগের বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে সংস্কারের নিমিত্ত কর্মচারীদের দাবি বাস্তবায়নে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা জনাব ড. আসিফ নজরুল সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি বাংলাদেশ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ আহ্বান জানায়।
অন্যথায় তারা খুব শীঘ্রই কর্ম বিরতিসহ কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।