কাজী শরীফ: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে হাসপাতালের বেডে মুমূর্ষু অবস্থায় থাকা একজন নারীর ছবি ভাইরাল হয়ে গেছে। ভদ্রমহিলার দাবি দ্বিতীয় স্বামী তাকে প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতন করেছেন। তার গাল বিভৎসভাবে কাটা ও তাতে ডাক্তার সাহেবের সেলাই দৃশ্যমান। মুখশ্রী নেই বললেই। তীব্র আঘাতে তাকে চেনাই দায়। ভদ্রমহিলা ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে সে বিভৎসতার বর্ণনা দিয়েছেন।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য অনেক শিক্ষিত মানুষ এ ঘটনার জন্য ভিকটিমকেই দায়ী করছেন। এমনকি অনেক নারীও ভিকটিমের বিপক্ষে লিখছেন। তারা দাবি করছেন মহিলা খুবই খারাপ। আগের একাধিক স্বামীকে তালাক দিয়ে তিনি টাকাপয়সা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ স্বামী অনেক কষ্ট থেকে এভাবে মারধর করেছেন। আমার বক্তব্য কিছু জায়গায়।
এক. তার এ স্বামী যে প্রথম নন তা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন।
দুই. যদি তার আগে আরও বিয়ে হয় সেটা ভদ্রলোক জানতেন কিনা, যদি জানেন তাহলে মহিলার দোষ কোথায়? আর যদি মহিলা তথ্য গোপন করেন তাহলে মারধরের বিকল্প পথ ছিল কিনা? যদি বিকল্প পথ থাকে এ শারীরিক নির্যাতনকে আপনি সমর্থন দেন কিনা?
তিন. তালাক দিয়ে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়ার ব্যাপারটা বুঝি না। আদালতে প্রায়ই স্বামীদের এ দাবি করতে দেখি। টাকা পয়সা বলতে যদি মোটা অংকের দেনমোহর বুঝিয়ে থাকেন সেজন্য মহিলাকে কেন দায়ী করছেন? আপনি জেনে বুঝে পড়ে কাবিননামায় স্বাক্ষর করে এখন দেনমোহরের পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন কিনা? সোনাদানার কথা অনেকে বলেন। কাবিননামায় দেখবেন উসুল বলে একটা কথা উল্লেখ থাকে। দশ লাখ টাকা দেনমোহর হলে দুই/ তিন/ পাঁচ লাখ টাকা উসুল থাকে যা স্বর্ণ ও অন্যান্য জিনিসবাবদ কাটা হয়।
আমি এজলাসে বসে সবসময়ই চেষ্টা করি সংসার মিলিয়ে দিতে। কিন্তু যখন দেখি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ একদমই নেই, পরস্পরের চোখে ন্যূনতম ভালোবাসা নেই তখন বলি ভেবে দেখেন এ মানুষটার সাথে বাকি জীবন কাটাতে পারবেন কিনা? না পারলে “চললাম বস” বলে আলাদা হয়ে যাওয়া সর্বোত্তম।
এভাবে দিনের পর দিন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে ও সহ্য করে সংসার নামক বিষয়টি টিকিয়ে রাখার মানে হয় না। যে ভদ্রমহিলার নিষ্ঠুর স্বামীর পক্ষে আপনি কথা বলছেন তিনি স্বাভাবিকভাবে বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারতেন। তিনি তা করেননি। কারণ তিনি সোজা রাস্তায় হাঁটতে চাননি। যে সোজা রাস্তায় হাঁটে না সে ভালো মানুষ নয়। স্ত্রীকে পশুর মত পেটানো কোন মানুষের পক্ষে এক লাইন লিখে ও ভিকটিম ব্লেমিং করে নিজেকেও ছোট প্রমাণ করবেন না।
আমি এজলাসে ওঠার আগে সূরা ফাতেহা পড়ে উঠি। সুরা ফাতেহার একটা আয়াত আমার খুব পছন্দের। “ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকিম (সূরা ফাতিহা: আয়াত ৫)”। যার অর্থ “হে আল্লাহ! আমাদিগকে সরলপথ দান করুন।” এজলাসে সবকিছু যেন সরলভাবে করতে পারি তাই এ সূরা পড়ে উঠি।
ভিকটিমকে দায়ী না করে অপরাধীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। মনে রাখবেন এ ঘটনা ঘটতে পারে আপনার নিজের, কন্যার বা বোনের জীবনে। তখন কি পারবেন ভিকটিমের দোষ নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে?
লেখক: কাজী শরীফ, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, চট্টগ্রাম।