২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি বগুড়ার বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক আবদুল বাকী হত্যার শিকার হন। এ ঘটনার পাঁচ দিন পর বগুড়া সদর থানায় একটি হত্যা মামলা হয়। নিহত আবদুল বাকীর বাবা ইয়াকুব আলী বাদী হয়ে ১৪ জনের নাম উল্লেখ এবং ৭ থেকে ৮ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে এই মামলা করেন।
২০১৯ সালের ২২ আগস্ট আদালত তদন্ত কর্মকর্তার চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সব আসামিকে খালাস দেন। ওই রায়ের পাঁচ বছর পর আবদুল বাকী হত্যার ঘটনায় আজ বুধবার বগুড়া সদর থানায় নতুন করে আবারও একটি হত্যা মামলা করা হয়েছে। এই মামলার বাদীও আবদুল বাকীর বাবা ইয়াকুব আলী।
নিহত আবদুল বাকীর বাড়ি বগুড়ার শেরপুর উপজেলার খামারকান্দি গ্রামে। তিনি ইসলামি ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে জানা গেছে।
বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইহান ওলিউল্লাহ আজকের মামলাটির তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ২০১৪ সালে শিক্ষক আবদুল বাকী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আজ তাঁর থানায় ৬৮ জনকে আসামি করে একটি মামলা হয়েছে। এখন আসামিদের বিষয়ে পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নতুন মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে সরকারি আজিজুল হক কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বেনজীর আহম্মেদকে। তিনি আগের মামলায়ও আসামি ছিলেন। তাঁকে ইতিমধ্যে এই হত্যার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। এ রকম আরও কয়েকজন খালাস পাওয়া আসামিকে একই অভিযোগে নতুন মামলার আসামি করা হয়েছে।
নতুন মামলায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের ১৮ নেতাকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও ৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন- সরকারি আজিজুল হক কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বেনজীর আহম্মেদ; জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাগর কুমার রায়; জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল রাজী জুয়েল; জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক এবং জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাশরাফী হিরো; জেলা যুবলীগের সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শুভাশীষ পোদ্দার (লিটন); জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নাইমুর রাজ্জাক (তিতাস); জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম; জেলা যুবলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার রায়; জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সজীব সাহা; বগুড়া শহর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আতাউর রহমান; সরকারি আজিজুল হক কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মশিউর রহমান; সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি স্বপন সরকার প্রমুখ।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি শিক্ষক আবদুল বাকীর বিয়ের দিন ধার্য ছিল। এর তিন আগে ২১ জানুয়ারি আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে বিয়ের ফুল কিনতে তিনি বগুড়া শহরের সাতমাথা ফুলপট্টিতে যান। আসামিরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে দেশি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ফুলপট্টিতে আবদুল বাকীকে ঘিরে ধরেন।
এ সময় ৮ নম্বর আসামি শুভাশীষ পোদ্দারের হুকুমে ১ নম্বর আসামি বেনজীর বার্মিজ চাকু দিয়ে আবদুল বাকীকে ছুরিকাঘাত করেন। পরে ৩ নম্বর আসামি আল রাজী, ৪ নম্বর আসামি মাশরাফী হত্যার উদ্দেশ্যে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করেন। অন্য আসামিরা রড ও লাঠি দিয়ে আবদুল বাকীর মাথায় আঘাত করেন। এ সময় রক্তাক্ত জখম হয়ে বাকী মাটিতে লুটিয়ে পড়লে অন্য আসামিরা লাঠি ও রড দিয়ে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
এ সময় সেখানে উপস্থিত লোকজন হত্যার ঘটনাটি দেখলেও আসামিরা সরকারদলীয় সন্ত্রাসী হওয়ায় কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করেননি। আবদুল বাকীর মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর আসামিরা ওই স্থান ঘিরে রাখেন। ঘণ্টাখানেক পর সাক্ষীরা আবদুল বাকীকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
এজাহারে আরও বলা হয়, লাশ দাফনের পর বাদী বগুড়া সদর থানায় মামলা দিতে গেলে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতাদের চাপে পুলিশ মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর গ্রহণ করে থানা থেকে তাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মামলা না করার জন্য হুমকি দেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর থানায় মামলার সিদ্ধান্ত নেন।
৫ বছর আগেই আদালতে নিষ্পত্তি
বগুড়া আদালতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষক আবদুল বাকী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি বগুড়া সদর থানায় একটি হত্যা মামলা রেকর্ড হয়। আবদুল বাকীর বাবা ইয়াকুব আলী বাদী হয়ে ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে এই মামলা করেন। মামলায় সাত থেকে আটজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।
মামলার উল্লেখযোগ্য আসামি ছিলেন সরকারি আজিজুল হক কলেজ শাখার সাবেক সভাপতি বেনজীর আহম্মেদ ও মশিউর রহমান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসলাম হোসেন, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাশরাফী হিরো, জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির নেতা তৌহিদ প্রমুখ।
মামলার তদন্ত শেষে প্রথমে পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। পরে পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁদের অব্যাহতির আবেদন জানিয়ে ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর বগুড়ার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (বগুড়া সদর) আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট আদালত চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করেন। এদিন আদালতের বিচারক মোহাম্মদ বিল্লাল হোসাইন আদেশ দেন।
মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাদীর প্রতি নোটিশ জারি ও জারি অন্তে তা ফেরত আসার পরও বাদী নারাজি দেননি। দুই দফা তদন্তে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল হয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন সত্য বলে গৃহীত হলো। আসামিদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হলো। মামলার নথিজাত আলামত বিধি মোতাবেক ধ্বংস করার নির্দেশ প্রদান করা হলো।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বাদী ইয়াকুব আলীর সঙ্গে বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। পূর্বের মামলার তথ্য গোপন রেখে নতুন করে থানায় মামলা দায়েরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না বলে জানান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়া জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সহসভাপতি আবদুল বাসেত বলেন, আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া কোনো হত্যা মামলার তথ্য গোপন করে নতুন করে তা থানায় দায়ের করার সুযোগ নেই। বাদীকে কোনো ধরনের চাপ বা ভয়ভীতি দেখানোর ঘটনা ঘটলে তিনি নতুন করে আদালতে রিভিশন মামলা করতে পারতেন। তথ্য গোপন করে ১০ বছর পর দ্বিতীয় দফায় একই বাদী থানায় করা এ মামলা টিকবে না। তদন্তেই তা শেষ হয়ে যাবে।