মোহাম্মদ ইয়াসিন আরফাত সাজ্জাদ: অধস্তন আদালতে রাষ্ট্র পক্ষে ফৌজদারি মামলা পরিচালনার জন্য সাধারণত জেলা/মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি), স্পেশাল পিপি, অতিরিক্ত পিপি, সহকারী পিপি নিয়োগ করে আইন মন্ত্রাণালয়। এর মধ্যে স্পেশাল পিপিরা জেলা/মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এর অধিনে নয়। তারা অনেকটা স্বশাসিত। যেমনটা “নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল” এর মতো বিশেষ ট্রাইবুনাল/বিশেষ জজ আদালত সমূহের বিচারক সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা জজ বা দায়রা জজের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। বরং সরাসরি আইন মন্ত্রাণালয় ও হাইকোর্ট বিভাগের অধীন। অনেকটা এরকম।
এ বিধান পরিবর্তন করা আশু জরুরী। কোর্ট সিএসআই, কোর্ট প্রসিকিউশন (পুলিশ), স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর, অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর, সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর সহ সংশ্লিস্ট সকলে অবশ্যই জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর, ক্ষেত্রমতে মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর এর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রাণাধীন থাকবেন, এমন আইনি সংশোধন জরুরী। ফৌজদারী মামলার আইও (IO) সাহেব তদন্ত প্রতিবেদন এর এমই (Memorandum of Evidence) অনুমোদন নেওয়ার সময় নিজ উর্ধতন কর্মকর্তার পাশাপাশি পাবলিক প্রসিকিউটর এর প্রতিস্বাক্ষর বাধ্যতামূলক করা দরকার।
তদন্তে অসঙ্গতি দেখলে, আইও সাহেব পুলিশ রিপোর্ট আদালতে দাখিল করার পূর্বেই পাবলিক প্রসিকিউটর প্রয়োজনে এমনকি পুনঃতদন্তের জন্য নোট দিবেন। সংশ্লিষ্ট দায়রা বিভাগের এবং ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের সমস্ত ফৌজদারী মামলায় সরকার পক্ষে পাবলিক প্রসিকিউটরকে তদারকি ও সমন্বয় এর দায়িত্ব পালন করার বিধান দরকার। পিপি অফিসের কার্যক্রম ও আওতা UK বা USA র মতো বৃদ্ধি করা দরকার, প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট ও আর্থিক সুবিধাদি সহ।
আরও পড়ুন: ইলেক্ট্রনিক মনিটরিং ও জামিনে শর্তারোপ বিতর্ক
পিপি, বিশেষ পিপি এবং অতিরিক্ত পিপি, সহকারী পিপিদের উপযুক্ত মাসিক সম্মানি দিয়ে বা সরকারী পে-স্কেলের সাথে হিসেব করে তাদের কর্মকালকে ফুলটাইম করে ব্যক্তিগত প্র্যাকটিস নিষিদ্ধ করা দরকার। সবচেয়ে উত্তম হবে এটর্নি সার্ভিস আইন প্রণয়ন করে স্থায়ী পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ করলে। যা প্রথমে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) ও সহকারী সরকারী কৌশুলী (এজিপি) পদ হতে শুরু হতে পারে।
প্রসঙ্গক্রমে বলি, ঠিক তেমনি প্রতিটি জেলায় জেলা জজের মূল পদকে আইন সংশোধন করে “সিনিয়র জেলা জজ” আদালতে রুপান্তর করে ঐ পদে শুধুমাত্র সিনিয়র জেলা জজদেরকে পদায়ন করে, জেলার অপরাপর সকল বিচারককে সিনিয়র জেলা জজের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত। সরাসরি আইন মন্ত্রাণলয় বা হাইকোর্ট বিভাগের অধীন হবেন না।
অন্যদিকে সিভিল মামলায়, সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য তিনভাবে আইনজীবী নিয়োগ হয়।
ক) আইন মন্ত্রণালয় নিয়োগ করে সরকারী কৌঁসুলি (জিপি), অতিরিক্ত সরকারী কৌঁসুলি, সহকারী সরকারী কৌঁসুলি (এজিপি), লোকাল সরকারী কৌশুলী (এলজিপি)। উনারা বিশেষকরে খাস জমি, অধিগ্রহণকৃত ভূমি নিয়ে, সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এবং সাধারণ সরকারী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মামলা দেখাশোনা করেন।
খ) ভূমি মন্ত্রণালয় নিয়োগ করে ভিপি কৌঁসুলি। তারা ভিপি মামলা তথা অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন বিষয়ক মামলা দেখাশোনা করেন।
গ) প্রায় সরকারী প্রতিষ্ঠান নিজস্ব আইনজীবী প্যানেল ও আইন উপদেষ্টা নিয়োগ করে, তাদের নিজস্ব মামলা পরিচালনার জন্য।
এখানে সরকারী স্বার্থের বিষয়ে এ তিনগ্রুপ আইনজীবীর মধ্যে কোন সমন্বয় নাই। কে কি করতেছেন, তা অন্য কেউ জানে না। যে যার মতো চলেন। প্রশ্ন হচ্ছে এর জন্য দায়ী কে? উত্তর: সরকারী আইনকানুন। সরকারের আইন মন্ত্রানালয় ও ভূমি মন্ত্রানালয় এর মধ্যে সমন্বয় নাই। অনেক সময় সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারী কৌঁসুলি (জিপি) দের সাথে যোগাযোগ না করে, নিজেদের মর্জি মাফিক চলার জন্য নিজস্ব আইনজীবী নিয়োগ করেন।
আরও পড়ুন: সংবিধান সচল না রহিত, সুস্পষ্ট নয়: এবি পার্টি ল’ ইয়ার্স
ফৌজদারির মতো দেওয়ানী সাইডে সবাই পার্টটাইম সরকারি আইনজীবী! ফলে সরকারী অর্থের অপচয় হয়। সরকারী স্বার্থ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয় মর্মে সরকারী কর্মকর্তাদের বিস্তর অভিযোগ। অন্তত জিপি পদটি সহ তাহার অফিসে স্থায়ী ৫-৫০ জন (জেলার আয়তন ও জনসংখ্যা অনুযায়ী) সরকারী দেওয়ানী আইন কর্মকর্তা আবশ্যক। সরকার প্রায়শঃ রাজনৈতিক বিবেচনায় তুলনামূলক অযোগ্য অদক্ষ আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দেন। এর সুরাহা দরকার।
সবচেয়ে হযবরল হচ্ছে ভিপি কৌশুলীরা। এরা প্রত্যেকে স্বশাসিত। এদের নিজের মধ্যেও সমন্বয় নাই। উনারা সরকারী কৌঁসুলি (জিপি) এর সহিত যোগাযোগ রাখেন না। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ আছে।
ডিসি অফিসের নিয়মিত ভূমি বিষয়ক মিটিংএ জিপি সাহেবকে সবাই সরকারী মামলা ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞেস করে। অথচ, তিনি সব মামলায় এনগেজড নন বা সবাই উনার অধিনে নয়। তাই সদুত্তর দিতে পারেন না। জিপি সাহেব সার্বিক বিষয়ে অবগত নন। সুনির্দিষ্ট বিধিবিধানের অনুপস্থিতিতে এবং সরকারী সকল আইনজীবীরা জিপির প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে না থাকায়, চাইলেও সরকারের সর্বোচ্চ স্বার্থ দেখার সুযোগ মূল জিপি সাহেবের তেমন নাই।
যেহেতু জিপি, ভিপি কৌঁশুলী উভয়কে ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয় নিয়োগ দিলেও, সকলে স্থানীয়ভাবে সকলে ডিসি অফিসের সাথে সংযুক্ত। অনেকটা নিয়ন্ত্রিত বলা যায়। ভূমি মন্ত্রণালয় হতে পৃথক ভিপি কৌশুলী নিয়োগ না করে, বিদ্যমান জিপি, অতিরিক্ত জিপি, সহকারী জিপি, এলজিপিদের খাস জমির পাশাপাশি ভিপি (অর্পিত) মামলা দেখাশোনা ও পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া দরকার। এতে জটিলতা কিছুটা কমবে। সরকারের আর্থিক খরচও কমবে। প্রয়োজনে দেওয়ানী আদালতের সংখ্যার দুই-তিনগুন এজিপি নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।
সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনায় বড় সমস্যা হচ্ছে
সিভিল মামলায় প্রচুর লেখালেখি ও ডকুমেন্টারি কাজ হয়। তাদের জন্য অফিস সহকারী বা স্টেনোগ্রাফার থাকে না৷ শুধুমাত্র মূল জিপির একজন সহকারী থাকেন। সরকারী অফিস/ভূমি অফিস হতে যথাসময়ে SF আসে না। প্রায়শ: অপরপক্ষকে (লেনদেন সহ) তদবির করতে হয়! এসএফ (SF) আসলেও সাপোর্টিং ডকুমেন্টস পাঠায় না। আবার ডকুমেন্টস পাঠালেও তা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মকর্তা দ্বারা সত্যায়িত করে পাঠায় না! ফলে যথাসময়ে কোন তদবিরই করতে পারেন না, লিখিত বর্ণনা দাখিল করতে পারেন না। ফলে সরকার পক্ষে ডকুমেন্টস এক্সিবিট করা যায় না। অধিকার সময় সরকার পক্ষে সাক্ষী পাওয়া য়্যায় না।
মামলা পরিচালনায় প্রচুর ডকুমেন্টস সংগ্রহ করতে হয় বা ফটোকপি করতে হয়। সে সাপোর্ট ডিসি অফিস বা ভূমি অফিস দেয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারী অফিসের মামলার বিবিধ ও বিভিন্ন রকমের খরচের বরাদ্দ থাকে না। আবার জিপি নিজে পকেটে টাকা খরচ করে চিটি চালাচালি করলে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি হয়, সরকারি কর্মচারীরা বিরক্ত হন, সহযোগিতা তেমন করে না বা তারা জমিজমার জটিল বিষয় বুঝেন না। এরকম হাজারো প্র্যাকটিক্যাল সমস্যা রয়েছে। যেন সব ঠেকা সরকারী আইনজীবীর। সরকারী কর্মচারীদের নিজ অফিসের সমস্যা নিয়ে কোন দায় নাই। মনে মনে দিন গুনে কখন এই অফিস/ডেস্ক হতে অন্য অফিসে/ডেস্কে বদলি হয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচবে। এসব প্যারায় সরকার পক্ষে আইনজীবীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। হতাশ হয়ে পড়েন। যেন সমস্যাটি/বিষয়টি কোন মা-বাপ নাই।
সরকারী কর্মকর্তারা বুঝতে চান না যে, তারা বা তাদের অফিস সরকারি আইনজীবীর মক্কেল। সরকারী আইনজীবীরা তাদের কর্মচারী নয়। ফলে যাচ্ছে তাই অবস্থা।
এলআর ম্যানুয়াল আপডেট করা আবশ্যক। সাথে সরকারী আইনজীবীদের সম্মানিও বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত। প্রয়োজনে স্হায়ী ও ফুলটাইমার জিপি নিয়োগ করা যায়। বর্তমানে দেওয়ানী মামলা পরিচালনার ফি চার্ট দিয়ে সিনিয়র আইনজীবী বা ভালো আইনজীবী ফিস তো দূরের কথা, তাদের মুহুরী এবং কম্পিউটার খরচও হবে না। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব হবে না।
লেখক: মোহাম্মদ ইয়াসিন আরফাত সাজ্জাদ; আ্যডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট (হাইকোর্ট বিভাগ) ও জাজেস কোর্ট, চট্টগ্রাম। ইমেইল: sajjadd215@gmail.com