ব্যারিস্টার কেয়া সেন: পৃথিবীর প্রত্যেকটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র তাদের নিজস্ব বিচার পদ্ধতি অনুসরণ করে দেশের অভ্যন্তরে সংঘটিত অপরাধের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। প্রতিটি দেশ তার স্বাধীন শাসন ও বিচার ব্যবস্থার দ্বারা দেশের অভ্যন্তরের সংঘটিত অপরাধের বিচারের ব্যবস্থা করে থাকে।
দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ২ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরের যে সমস্ত অপরাধ সংঘটিত হয় তার শাস্তির কথা এবং একই আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে এমন কিছু অপরাধের কথা যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সীমারেখার বাইরে সংঘটিত হয়েছে কিন্তু আইন বলে তা বাংলাদেশে শাস্তিযোগ্য এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরের বিচার ব্যবস্থা দ্বারা উক্ত অপরাধীর বিচারকার্য সম্ভব সেই ব্যাপারে।
অর্থাৎ,বাংলাদেশী নাগরিক কর্তৃক কোন অপরাধ যদি বাংলাদেশের বাহিরে সংঘটিত হয় কিন্ত, আইনবলে তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিচারযোগ্য ঐ সমস্ত ব্যক্তির অপরাধের বিচার এমনভাবে করা হবে যেটি বাংলাদেশের সংঘটিত হলে যেভাবে বিচার করা হতো ঠিক সেভাবেই।
এবার দেখা যাক আভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অপরাধীদের প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত আইনের ব্যাপারে। বর্তমানে বিশ্বায়নের এই যুগে যখন পুরো পৃথিবী মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে এবং বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধার হেতু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় অপরাধীগণ এক দেশে অপরাধ সংঘটিত করে অন্য কোন দেশে পালিয়ে যায়, বিচার ব্যবস্থা থেকে নিজেদেরকে প্রতিহত করার জন্য, অর্থাৎ নিজেদেরকে বিচার ব্যবস্থার আওতায় ধরা না দিয়ে আত্মগোপন করে থাকে অন্য কোন রাষ্ট্রে যা তাদের নিজ রাষ্ট্রের আওতা বহির্ভূত।
এই সকল অপরাধীদের তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের আওতাধীন করার জন্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত চুক্তি বা আইন হচ্ছে বন্দী প্রত্যর্পণ আইন বা চুক্তি (The Extradition Act)এই আইনের বলে পারস্পরিক বন্দি চুক্তি স্বাক্ষরিত দেশগুলি একে অপরের অপরাধীকে ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে। বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি যা আন্ত-রাষ্ট্রীয় হয়ে থাকে।
সাধারণত এক দেশের নাগরিক তার নিজ দেশে অপরাধ করে বন্দীদশা এড়ানোর জন্য অভিযুক্ত বা দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি অন্য কোন দেশে আশ্রয় নেয়। প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত প্রথম আইন পাশ হয়েছিল বেলজিয়ামে ১৮৩৩ সালে। তবে আন্ত-রাষ্ট্রীয় অপরাধীকে প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু শর্ত রয়েছে।
যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
১। যে অপরাধীর জন্য প্রত্যর্পণ চাওয়া হচ্ছে সে যেই অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছে উক্ত অপরাধটি উভয় দেশেই অপরাধ বলে বিবেচিত হতে হবে
২। যে কোন রাষ্ট্র প্রত্যর্পণকারীকে শুধুমাত্র সেই অপরাধের জন্য বিচার করতে পারে যার জন্য প্রত্যর্পণ মঞ্জুর করা হয়েছিল অর্থাৎ অন্য কোন অপরাধের এক্ষেত্রে বিচার করা যাবে না
৩। কৃত অপরাধটির শাস্তি যদি এক বছরের কম হয় সে ক্ষেত্রে প্রত্যর্পণ আইন দ্বারা কোন অপরাধীকে ফেরত দিতে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র বাধ্য নয়
৪। কোন রাষ্ট্র কোন অপরাধীকে ফেরত দিবে না যদি উক্ত রাষ্ট্র এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে অভিযুক্ত অপরাধী বা দোষী সাব্যস্ত অপরাধী কোন রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী এবং তাকে রাজনৈতিক মামলাতে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তাকে ফেরত দিতে ওই রাষ্ট্র বাধ্য নয় অর্থাৎ রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণকারী কোন অপরাধীকে প্রত্যর্পণ চুক্তির মাধ্যমে ফেরত দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়।
বাংলাদেশেও প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত একটি আইন প্রচলিত আছে যেটি বন্দি প্রত্যর্পণ আইন, ১৯৭৪ (The Extradition Act, 1974) নামে পরিচিত, যেখানে বন্দি প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।
বন্দি প্রত্যর্পণ আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী যখনি বাংলাদেশে এবং কোন বিদেশি রাষ্ট্রের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি সম্পাদিত হবে তৎক্ষণাৎ সরকার সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সেই রাষ্ট্রকে চুক্তিভুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে। অর্থাৎ বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিটি একটি চলমান প্রক্রিয়া যেটি বাংলাদেশ সরকার যে কোন সময়ে যেকোনো দেশের সাথে নতুন করে চুক্তিবদ্ধ হতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে ভারত এবং থাইল্যান্ডের সাথে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি প্রচলিত রয়েছে।
একই আইনের ৪ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ক্ষেত্রবিশেষে প্রত্যর্পণ চুক্তি বহির্ভূত কোন দেশের কোন অপরাধী যদি বাংলাদেশে অবস্থান করে তাহলে ওই দেশের সাথে প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকা সত্ত্বেও সরকার, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা ওই অপরাধীকে সংশ্লিষ্ট প্রত্যর্পণ চুক্তি বহির্ভূত রাষ্ট্রে ফেরত দিতে পারবে এবং সেই রাষ্ট্রকে চুক্তিভুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে।
আবার ৫ ধারা অনুযায়ী প্রত্যর্পণ চুক্তিভুক্ত দেশের কোন বিদেশি পলাতক আসামী বাংলাদেশে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে না যদি তার কর্তৃক কৃত অপরাধটি রাজনৈতিক চরিত্রের হয়, অপরাধটির শাস্তি যদি কমপক্ষে এক বছরের কম হয়, আত্মসমর্পণ করা হলে তার বিচার জাতি, ধর্ম, আত্মীয়তা বা রাজনৈতিক মতামতের কারণে প্রভাবিত হইতে পারে এবং যার দরুন তার ব্যক্তি স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হতে পারে এইসব বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিদেশি অপরাধীরা প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে না।
বন্দী প্রত্যর্পণ আইন, ১৯৭৪ অনুযায়ী কোন চুক্তিভুক্ত দেশ হতে যদি কোন অপরাধী পালিয়ে বাংলাদেশ আসে এবং উক্ত অপরাধীর বিরুদ্ধে তার নিজ দেশে যদি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারী হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার উক্ত গ্রেফতারী পরোয়ানা নির্ধারিত পদ্ধতিতে অনুমোদন করতে পারবে এবং তাকে বাংলাদেশের আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করতে পারবে। ম্যাজিস্ট্রেট যত দ্রুত সম্ভব তাকে কারাগারে প্রেরণ করবেন অথবা ক্ষেত্রবিশেষে জামিনে মুক্তি দিতে পারবেন।
ম্যাজিস্ট্রেট প্রত্যর্পণের আদেশ যুক্ত পলাতক আসামির তদন্ত কার্য সম্পাদন করতে পারবেন এবং এক্ষেত্রে ফৌজদারী কার্যবিধিতে বর্ণিত তদন্ত পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তের ক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন যে যেই অপরাধে বিদেশী পলাতক ব্যাক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তা কোন রাজনৈতিক চরিত্রের অপরাধ নয় এবং যার দরুন সেটি প্রত্যর্পণ যোগ্য নয়। তদন্ত শেষে ম্যাজিস্ট্রেট রিপোর্ট প্রদান করবেন সংশ্লিষ্ট আইনের ১০ ধারা মোতাবেক।
যদি তদন্ত সাপেক্ষে দেখা যায় যে সমর্পণের জন্য অনুরোধ করা হলেও প্রাথমিকভাবে কোন তথ্য প্রমাণ পাওয়া না যায় সে ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট পলাতক বিদেশী ব্যাক্তিকে অব্যাহতি প্রদান পূর্বক সরকারের নিকট একটি প্রতিবেদন প্রেরণ করবেন। আর যদি দেখা যায় যে প্রাথমিকভাবে তার অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে সে ক্ষেত্রে তিনি সরকারের নিকট তার তদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণ করবেন, পলাতক বিদেশী অপরাধী সরকারের বিবেচনার জন্য কোন লিখিত বিবৃতি প্রদান করিতে চাহিলে তাহা উক্ত প্রতিবেদনের সহিত একত্রে প্রেরণ করবেন এবং জামিন সংক্রান্ত যেকোনো বিধান সাপেক্ষে সরকারের আদেশ প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত অপরাধীকে কারাগারে প্রেরণ করবেন।
ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক উক্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর সরকার যদি মনে করে পলাতক অপরাধীকে সমর্পণ করা উচিত তাহলে পলাতক অপরাধীকে হেফাজত এবং অপসারণ এর জন্য পরোয়ানা জারি করতে পারবে এবং কোন ব্যক্তির নিকট অপরাধীকে হস্তান্তর করতে হবে এবং কোন স্থানে হস্তান্তর করতে হবে তা উল্লেখ করবেন।
আবার বন্দি প্রত্যর্পণ আইনের ১২ ধারা অনুযায়ী যদি দুই মাসের মধ্যে ধৃত পলাতক ব্যক্তিকে সমর্পণ না করা হয় তাহলে হেফাজতে নেওয়ার দুই মাসের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগ পলাতক অপরাধীর বা তার পক্ষ হতে আবেদন সাপেক্ষে উক্ত বন্দীকে অব্যাহতির আদেশ প্রদান করতে পারবেন।
তবে প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধটি যদি বাংলাদেশ সরকারের নিকট মনে হয় তুচ্ছ মামলা এবং তা অসৎ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে যার ন্যায় বিচারের পরিপন্থী সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার যদি মনে করে উক্ত অপরাধীকে ফেরত দেওয়া অসমীচীন হবে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার পলাতক অপরাধীকে অব্যাহতি প্রদান করতে পারবে।
আবার বন্দি প্রত্যর্পণ আইনের ১৫ ধারার বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের কোন অপরাধী যদি অন্য কোন চুক্তিভুক্ত রাষ্ট্রে অবস্থান করে সে ক্ষেত্রে তাকে বাংলাদেশে সমর্পণের জন্য আবেদন করতে পারবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের নিয়োজিত উক্ত রাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রতিনিধির নিকট অথবা উক্ত রাষ্ট্রে নিয়োজিত বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধির মাধ্যমে উক্ত রাষ্ট্রের সরকারের নিকট আবেদন করতে পারবেন।বন্দি প্রত্যর্পণ আইন এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যেন চুক্তিভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বন্দি বিনিময় যথাযথ ভাবে সম্পাদন করা সম্ভব হয়।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।