নুসরাত জাহান আনিকা: মানব সভ্যতার ইতিহাসে নারী ও পুরুষ সমানভাবে মর্যাদা পেয়েছে, কারণ উভয়েই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। কিন্তু সমাজে বিভিন্ন সময়ে নারীকে অনেক ধরনের বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। আধুনিক যুগে নারী অধিকার ও নিরাপত্তার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০” এবং পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ প্রণয়ন করেছে, যা নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। তবে প্রশ্ন হলো, এই আইন নারীদের কতটুকু সুরক্ষা দিতে সক্ষম? এই প্রবন্ধে আমরা নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এই আইনের কার্যকারিতা, চ্যালেঞ্জ, এবং প্রাসঙ্গিক সামাজিক ও পারিবারিক বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করব।
নারী নির্যাতনের বর্তমান প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে নারী নির্যাতন একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই নারী নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়—ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, অ্যাসিড হামলা, পারিবারিক নির্যাতন, এবং যৌতুকের জন্য অত্যাচার এর কিছু সাধারণ উদাহরণ। বিশেষ করে, গ্রামের দরিদ্র নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অন্যদিকে, শহুরে শিক্ষিত নারীরাও পারিবারিক সহিংসতা ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তবে অনেক ক্ষেত্রে এসব ঘটনা সমাজে প্রকাশিত হয় না।
এছাড়াও, বাংলাদেশে শিশু বিবাহ, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নারী নির্যাতনের মূল কয়েকটি কারণ হিসেবে বিদ্যমান। এই নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর ভুক্তভোগী পরিবারগুলো অনেক সময় সামাজিক লজ্জা বা ভয় থেকে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে ইতস্তত করে। এর ফলে, প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, এবং অনেক নির্যাতন ঘটনাই অনতিবিলম্বে বিচার প্রক্রিয়ায় উপস্থাপিত হয় না।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ভূমিকা
বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন”প্রণয়ন করে। এই আইনের আওতায় ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, এবং অন্যান্য গুরুতর অপরাধের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এই আইনে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়াও, আইনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীরা দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন এবং দ্রুত ন্যায়বিচার পান।
তবে আইনটি সুরক্ষার পাশাপাশি একটি কঠোর বার্তা দেয় যে নারী নির্যাতন আর কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না। আইনের অধীনে নির্যাতিত নারীরা থানায় মামলা করতে পারেন এবং তাদের প্রতি হওয়া সহিংসতা সম্পর্কে কথা বলতে পারেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের পাশাপাশি, “পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন”, ২০১০ প্রণয়ন করা হয় নারীদের পারিবারিক সহিংসতা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। এই আইনের মাধ্যমে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার নারী, শিশু, ও বৃদ্ধদের আইনি সহায়তা ও সুরক্ষা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আইনের আওতায় পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুরা থানায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন এবং পুলিশের কাছ থেকে তাত্ক্ষণিক সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন। এছাড়াও, আদালতে মামলা দায়ের করে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করার সুযোগ রয়েছে।
আইনের সীমাবদ্ধতা ও অপব্যবহার
যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটি একটি কঠোর আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এর অপব্যবহার এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। বিবিসির —একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের অনেক মিথ্যা মামলা হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে যে, প্রায় ৮০ শতাংশ নারী নির্যাতনের মামলায় কোনো প্রমাণ মেলে না। এর প্রধান কারণ হলো আইনটি জামিন অযোগ্য ছিল এবং কঠোর শাস্তির বিধান থাকায় কিছু মানুষ ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা বা সম্পত্তিগত বিরোধের জন্য মিথ্যা মামলা দায়ের করেন।
অনেক সময় মিথ্যা মামলা দায়েরের কারণে আসল অপরাধীর শাস্তি পেতে দেরি হয় এবং ভুক্তভোগীর ন্যায় বিচার বিলম্বিত হয়। মামলার জটিলতা এবং আইনি প্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণে ভুক্তভোগী পরিবাররা বিচার প্রক্রিয়ার ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। অন্যদিকে, মিথ্যা মামলাগুলো তদন্ত প্রক্রিয়ায় জটিলতা সৃষ্টি করে, যার ফলে প্রকৃত অপরাধীরা অনেক সময় আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ছাড়া পেয়ে যান।
পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রভাব
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করলেও এটি যথেষ্ট নয়। পরিবার এবং সমাজে নারীর প্রতি সম্মান ও মূল্যবোধের অভাব নারী নির্যাতনের অন্যতম প্রধান কারণ। প্রতিটি পরিবারের অভিভাবক যদি তাদের সন্তানদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ তৈরি করেন, তবে সমাজে নারী নির্যাতনের হার অনেকাংশে কমে আসতে পারে।
আমাদের সমাজে অনেক সময় মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা থাকে। পিতামাতারা অনেক সময় ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ করেন, যা পরে মেয়েদের প্রতি অবহেলা এবং নির্যাতনের দিকে নিয়ে যায়। মেয়েদের পারিবারিক ও সামাজিক সম্মান রক্ষা করার দোহাই দিয়ে তাদের স্বাধীনতাকে সীমিত করা হয়, যা নারী নির্যাতনের একটি কারণ হিসেবে দাঁড়ায়।
আইন প্রয়োগে দক্ষতার প্রয়োজন
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হলে আইন প্রয়োগের দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতা এবং স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে যাতে মিথ্যা মামলাগুলো দ্রুত বাতিল করা যায় এবং প্রকৃত অপরাধীরা দ্রুত শাস্তি পায়।
এছাড়াও, তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে যাতে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হয়। অনেক সময় সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহে বিলম্বের কারণে বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয় এবং অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়। এজন্য ডিজিটাল প্রমাণ সংগ্রহের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
নারীর প্রকৃত সুরক্ষা ও পরিবর্তন
আইন প্রণয়ন এবং তার সঠিক প্রয়োগের পাশাপাশি সমাজে নারীর প্রতি সম্মান ও মূল্যবোধ সৃষ্টি করাই নারী নির্যাতন প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি। যদি পরিবার ও সমাজে নারীর প্রতি সম্মান, মূল্যবোধ, এবং নৈতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে আইনের ওপর নির্ভরতা কমে আসবে এবং নারী নির্যাতনের হারও কমবে।
ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি পরিবারকে তাদের সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দিতে হবে। সন্তানদের মধ্যে মানবিকতা, সমতা এবং সহানুভূতির মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে। তবেই সমাজে নারী নির্যাতন বন্ধ হবে এবং নারীরা নিজেদের নিরাপদ মনে করবেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এবং পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ নারীদের সুরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও, একমাত্র আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয়।
নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সামাজিক, পারিবারিক, এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের উন্নতি করতে হবে। আইন যেন অপব্যবহারের শিকার না হয়, সেই দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের সন্তানদের মধ্যে সম্মান, ন্যায়বিচার, এবং মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা প্রদান করা। একইসঙ্গে, মিথ্যা মামলার প্রবণতা রোধে আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের উচিত নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা। তাহলেই নারীরা প্রকৃতপক্ষে সুরক্ষিত হবে এবং সমাজে তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে
সর্বোপরি, আমাদের সমাজে নারীদের প্রতি সম্মান এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজের প্রত্যেকটি স্তরের মানুষকে একযোগে কাজ করতে হবে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা এবং নারীদের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হলে তবেই আইনটি তার আসল লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে এবং নারীরা নিজেদের সত্যিকারের সুরক্ষিত মনে করবেন।
লেখক: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।