রবিউল ইসলাম: গত ২১ সেপ্টেম্বর দেশের জেলা বিচার বিভাগে কর্মরত বিচারকদের উদ্দেশ্যে এক দিক—নির্দেশনামূলক অভিভাষণ প্রদান করেন দেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি। সুপ্রীম কোর্টের মূল ভবনের ইনার গার্ডেনে আয়োজিত অভিভাষণ অনুষ্ঠানে দেশের জনগণকে জাতীয় দুর্বিপাক থেকে উত্তোরণপূর্বক একটি জনমুখী আইন ব্যবস্থা ও বিচার কাঠামো বিনির্মাণে করণীয় সম্পর্কে একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ ঘোষণা করেন মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও অ্যাটর্নি জেনারেল মোঃ আসাদুজ্জামান।
প্রায় ৪৯ মিনিটের অভিভাষণে মাননীয় প্রধান বিচারপতি নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা থেকে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করা জরুরী মর্মে চিহ্নিত করেন।অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি খুব স্পষ্টভাবেই বলেন ‘বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার স্বার্থে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক। দেশের সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে অধস্তন আদালতের বিচারকেরা বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন বলে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না, যত দিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান দ্বৈত শাসনব্যবস্থা অর্থাৎ, সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটিই হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ।’
আলোচিত অভিভাষণটি যদি আমরা শুনে থাকি তাহলে বিচার বিভাগের একজন সদস্য হিসেবে গর্বের সাথে বলতে পারি যে, স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচার বিভাগ গঠনের জন্য সংস্কারের প্রয়োজনীয় দিক চিহ্নিতকরণ ও তার রুপরেখা তুলে ধরার ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধান বিচারপতি কোন ধরণের লুকোচুরি না করে স্পষ্ট ভাষা ও বাক্য ব্যবহার করেছেন। সংস্কারের কাজ সম্মিলিতভাবে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধান বিচারপতি অনুষ্ঠানে উপস্থিত মাননীয় আইন উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের অভিভাষণের মত এতটা স্পষ্ট করে না হলেও ইতোপূর্বে কোন কোন প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক সরকার সে আহ্বানে বিন্দুমাত্র সাড়া দেন নি। তবে, এবার আশার কথা হলো মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হওয়া অন্তবর্তীকালীন সরকার বরাবরই বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে আসছেন।
পাশাপাশি, মাননীয় আইন উপদেষ্টা অন্তবর্তর্ীকালীন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিচার বিভাগের সংস্কার সংস্কারের প্রশ্নে একাধিকবার বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলেছেন। গত ২৫ আগস্ট ইংরেজী জাতীয় দৈনিক ডেইলি স্টারে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাননীয় আইন উপদেষ্টা স্পষ্ট করেই বলেন, ‘অধস্তন আদালতের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের অর্থই হলো তার উপর উচ্চ আদালত তথা সুপ্রীম কোর্টের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।’ উচ্চ আদালত অধস্তন আদালতকে তত্ত্বাবধায়ন ও নিয়ন্ত্রণ করবে এবং সেখানে সরকার কোন ধরণের হস্তক্ষেপ করবে না মর্মে সাক্ষাৎকারে জানান ড. আসিফ নজরুল।
অন্যদিকে, অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে যোগদানের পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে স্বাধীন ও শক্তিশালী বিচার বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পৃথক সচিবালয়ের বিকল্প নেইমর্মে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান জানান। চ্যানেল টুয়েন্টি ফোর এ প্রচারিত হওয়া একটি প্রতিবেদনে অ্যাটর্নি জেনারেল পরিষ্কার ভাষায় বলেন, বিচার বিভাগের নিশ্চয়ই আলাদা সচিবালয় হওয়া দরকার। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে মাননীয় প্রধান বিচারপতিসহ সরকার প্রধানদের চিন্তার এমন সম্মিলন পূর্বে দেখা যায় নি।
গত দেড় দশকে জেলা বিচার বিভাগের উপর আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চালানো নির্বাহী বিভাগের নগ্ন হস্তক্ষেপ দেশের মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা কতটা জরুরী। তাই, দেশের বিচার বিভাগের প্রত্যেক সদস্য, আইনজীবী ও সচেতন সমাজ নির্দ্বিধায় অন্তবর্তীকালীন সরকারের নিকট নিবার্হী ও আইনসভার হস্তক্ষেপমূক্ত স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রত্যাশা করে আসছেন। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জেলা বিচার বিভাগের সদস্যদের উদ্দেশ্যে দেওয়া নবনিযুক্ত মাননীয় প্রধান বিচারপতির অভিভাষণ বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট জনসহ দেশের মানুষের মনে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে।
মাননীয় প্রধান বিচারপতির অভিভাষণের মাধ্যমে বিচার বিভাগ সংস্কারের প্রশ্নে সরকার ও বিচার বিভাগ প্রধানের চিন্তাধারার মিল খুঁজে পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট সকলের চোখ এখন সংস্কারের বাস্তবায়ন দেখার অপেক্ষায়। মাননীয় প্রধান বিচারপতির তুলে ধরা রোডম্যাপের আলোকে সদাশয় সরকার বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিশ্চিতে সুপ্রীম কোর্টের অধীনে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতঃ বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে ন্যায় বিচার নিশ্চিতে কাজ করার সুযোগ করে দিবে, এমনটাই প্রত্যাশা বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টদের।
লেখক: রবিউল ইসলাম; সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, নওগাঁ। ই—মেইল: : rabiul.judge@gmail.com