মামলার বিচারিক কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তিকরণের লক্ষ্যে ঢাকা জজ কোর্টে আদালত ভবন নির্মাণ, এজলাস, বিচারক সংখ্যা বৃদ্ধি ও ফৌজদারি মামলাসমূহের বদলি রেজিস্ট্রার ডিজিটালাইজেশনসহ ৬ দফা দাবিতে সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন জানিয়েছে আইনজীবীরা।
ল’ইয়ার্স ইনিশিয়েটিভ ফর অল -এর পক্ষে ৬ জন আইনজীবী গতকাল সোমবার (১৪ অক্টোবর) এ আবেদন করেন।
আবেদনকারী ছয় আইনজীবী হলেন- ল’ইয়ার্স ইনিশিয়েটিভ ফর অল -এর উপদেষ্টা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এস এম জবিরুল হক কাজল, হুমায়ূন কবির সরকার, ল’ইয়ার্স ইনিশিয়েটিভ ফর অল -এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মেহেদী হাসান, সহ পৃষ্ঠপোষক অ্যাডভোকেট মো. খুরশিদ আলম, ল’ইয়ার্স ইনিশিয়েটিভ ফর অল -এর সদস্য অ্যাডভোকেট মো. ওবায়দুল্লাহ কাজী ও মো. জুয়েল রানা।
আইন সচিব, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর এ আবেদন করা হয়। এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা, অ্যাটর্নি জেনারেল, আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতির একান্ত সচিব, ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ, মহানগর দায়রা জজ, সিজেএম ও সিএমএম -কে আবেদনের অনুলিপি প্রেরণ করা হয়েছে।
আবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্ববৃহৎ আইনজীবী সমিতি ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশন। সমিতির বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৩১ হাজার ৩০৫ জন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ঢাকা শহরে প্রায় ২ কোটিরও বেশি মানুষ বসবাস করে এবং এসব মানুষ বিচারপ্রার্থী হয়ে আইনগত প্রতিকারের জন্য নিয়মিত ঢাকা জজ কোর্টে আসেন।
বর্তমানে ঢাকা জজ কোর্টে হাজার হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে এবং সব মামলার নিষ্পত্তির জন্য যে পরিমাণ আদালত ভবন, এজলাস ও বিচারক প্রয়োজন তার ন্যূনতমও আদালত ভবন, এজলাস ও বিচারক নেই।
পর্যাপ্ত পরিমাণ আদালত ভবন, এজলাস ও বিচারক না থাকায় মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ায় আইন, আদালত ও আইনজীবীদের উপর জনগণের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে।
শুধু তাই নয়, ঢাকা জজ কোর্টে বিচারাধীন মামলা তথা নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্ট (এন.আই. অ্যাক্ট)- ১৮৮১, মাদক ও পিটিশন মামলার পরিমাণ অনেক বেশি যার বিচারের ক্ষমতা শুধুমাত্র জেলা ও দায়রা জজ আদালত ও মহানগর দায়রা জজ আদালতের রয়েছে।
এসব মামলাসমূহ চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালত, চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে রুজু হওয়ার পর বিচারের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং মহানগর দায়রা জজ আদালতে বদলি/স্থানান্তরিত হয়।
পরবর্তীতে জেলা ও দায়রা জজ আদালত ও মহানগর দায়রা জজ আদালতের রেজিস্ট্রার বহিতে এসব মামলাসমূহ এনালগ পদ্ধতিতে হস্তলিখিতভাবে লিপিবদ্ধপূর্বক এখতিয়ার সম্পন্ন বিভিন্ন বিচারিক আদালতে বিচারের জন্য বন্টন করা হয়।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, বিচারাধীন বদলি মামলাসহ অন্যান্য মামলাসমূহের নির্ধারিত বিচারিক আদালতের নম্বর, পরবর্তী তারিখ, দায়রা (মামলা) নম্বর সংগ্রহের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালত ও মহানগর দায়রা জজ আদালতের ফৌজদারি মামলার বদলি সেকশন/সেরেস্তা কক্ষ অত্যন্ত সংকীর্ণ ও ছোট হওয়ায় বদলি রেজিস্ট্রার দেখতে গিয়ে আইনজীবীদের প্রচণ্ড ভিরের মধ্যে অবর্ননীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অনেক সময় আইনজীবীদের মধ্যে বাকবিতণ্ডাসহ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
উল্লেখ্য যে, অতিরিক্ত ব্যব ও পাতাসমূহ উল্টানোর সময় বদলি রেজিস্ট্রার বহির পাতা ছিড়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেক মামলা খুঁজে পাওয়া যায়না।
আবার বিচারিক আদালতে বিচার কার্যক্রমে মামলা সমূহ একটি শুনানির তারিখ থেকে পরবর্তী শুনানির তারিখ ১০ থেকে ১১ মাস পড়ে ধার্য করা হয়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
মামলার এসব দীর্ঘ তারিখ ধার্য হওয়ায় কারণে বিচারপ্রার্থীগণ আইনজীবীদের ভুল বুঝে থাকেন এই কারণে যে, কেন মামলার তারিখ ১০-১১ মাস পড়ে ধার্য হয়! যদিও এর একমাত্র কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত পরিমাণ এজলাস ও বিচারক সংখ্যা না থাকা, যা বিচারপ্রার্থী ও সাধারণ জনগণকে বোঝানো কঠিন হয়ে যায়।
আরো উল্লেখ্য যে, ইতোপূর্বে ঢাকা জেলা জজ আদালতে ফৌজদারি মামলাসমূহের বদলি রেজিস্ট্রার ডিজিটালাইজেশনের লক্ষ্যে আইনজীবীদের নেতৃত্বে মানববন্ধন করা হয় ও বিভিন্ন সময় দাবী জানানো হয়।
কিন্তু দীর্ঘ সময় পেরিয়ে হেলেও অদ্যাবধি কার্যক্রমসমূহ ডিজিটালাইজেশন না হওয়ায় আইনজীবীদের প্রায়ই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে এবং বিচারপ্রার্থীগণ ন্যায় বিচার থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি মামলার দীর্ঘসূত্রিতা বৃধির কারণে বিচার বিভাগসহ সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।
যেহেতু, বাংলাদেশ সরকার দেশ বিনির্মাণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন এবং যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে স্বচ্ছতার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম মামলার কার্যক্রমসমূহ অনলাইন ডিজিটালাইজেশ (এপস ও ওয়েবসাইট) -এর মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।
এছাড়া ২০১৫ সাল বাংলাদেশ সরয়ারের পক্ষ থেকে অনলাইন ঢাকা জজ আদালতসহ বাংলাদেশের সকল অধস্তন আদালতের মামলার কার্যক্রমসমূহ অনলাইন ডিজিটালাইজেশন (এপস ও ওয়েবসাইট) এর মাধ্যমে প্রকাশ করার জন্য বাজেট পাশ করেন এবং ওয়েবসাইট পোর্টালও (https//causelist.judiciary.gov.bd/causelist) তৈরি করা হয়।
কিন্তু অজ্ঞাত কারণে মামলার কার্যক্রমসমূহ অনলাইন ডিজিটালাইজেশন (এপস ও ওয়েবসাইট) এর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়না।
সেহেতু আইনজীবীদের আইনজীবীদের হয়রানি ও দুর্ভোগ রোধকল্পে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত থেকে মহানগর দায়রা জজ আদালতে এবং চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত (সিজেএম) আদালত থেকে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য প্রেরিত ফৌজদারি মামলাসমূহের বদলি রেজিস্ট্রার অবিলম্বে ডিজিটালাইজেশন করা আবশ্যক।
যেহেতু, মানুষ অনন্তকাল বেঁচে থাকে না, তাই বয়সের ভারে অনেক বয়স্ক আইনজীবী ও সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের চলাফেরার এনার্জিও থাকে না। ফলে এক কোর্ট থেকে আরেক কোর্টে সহজে যেতে পারেন না। এক্ষেত্রে উঁচু ভবনসমূহে উঁচু গ্যাংওয়ে নির্মাণ হওয়া জরুরি, কারণ পর্যাপ্ত পরিমাণে লিফট না থাকায় মামলার শুনানির জন্য কোর্টে যেতে আইনজীবী ও সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের বিলম্ব ঘটে।
অনেক সময় আইনজীবীদের ৯ তলা পর্যন্ত সিঁড়ি বেয়ে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। প্রয়োজনমতে এক্সটেনশন লিফট নির্মাণ করা আবশ্যক।
পাশাপাশি, যেহেতু গ্রীষ্মকালে দাবদাহে আইনজীবীদের পোশাক পরিধান করে কোর্টে শুনানি করতে হয় এবং প্রচণ্ড তাপমাত্রায় প্রথিতযশা আইনজীবী প্রায় ২০০ আইনজীবী হিট স্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করেছেন বিধায় সার্বিক বিবেচনায় আদালতের সকল এজলাস, সকল সেকশন এবং সেরেস্তায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (AC) স্থাপন করা মানবিক কারণে জরুরি হয়ে পরেছে।
সাধারণ আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত সাধারণ আইনজীবী সমাজ আদালত ভবন, এজলাস ও বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধিত দাবিতে নিম্নোক্ত দাবীসমূহ উপস্থাপন করেন –
১. মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিকরণ, জন দুর্ভোগ লাঘবে ও ন্যায় বিচার নিশ্চিতকরণে ঢাকা জেলা জজ আদালতে মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের সামনে টিনশেড ভবনের স্থলে জরুরিভাবে এজলাস ভবন নির্মাণ করে সেখানে যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতের এজলাস (প্রয়োজনমতে অন্যান্য আদালতের এজলাস) বাড়ানো ও নিয়মিত বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা।
২. চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত থেকে মহানগর দায়রা জজ আদালতে এবং চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য প্রেরিত ফৌজদারি মামলাসমূহের বদলি রেজিস্ট্রার ডিজিটালাইজেশনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৩. বয়স্ক আইনজীবী ও বয়স্ক মক্কেলদের জন্য সিএমএম কোর্ট থেকে সিজেএম কোর্ট এবং সিজেএম কোর্ট থেকে জেলা ও দায়রা আদালত এবং মহানগর দায়রা জজ আদালত পর্যন্ত জরুরিভাবে ৫ম, ৭ম তলায় উঁচু গ্যাংওয়ে নির্মাণ করা।
৪. ন্যায় বিচার নিশ্চিতকরণে রায় ও আদেশ দ্রুত প্রচারের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সংখক সাটলিপি মুদ্রাক্ষরিক (স্টেনোগ্রাফার) -এর সংখ্যা বাড়ানো এবং থানার মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে জি.আর সেকশনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে রুম তৈরি করা।
৫. সিএমএম আদালত, সিজেএম আদালত, মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এক্সটেনশন লিফট স্থাপন করা।
৬. তীব্র গরম ও দাবদাহের কারণে আদালতের সকল এজলাস, সেকশন এবং সেরেস্তায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (AC) স্থাপন করা।
উল্লেখ্য, সচেতন আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত ল’ইয়ার্স ইনিশিয়েটিভ ফর আল একটি অলাভজনক, সেবামূলক ও অরাজনৈতিক সংগঠন এবং ঢাকা জজ কোর্টসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন কোর্টে বিভিন্ন ধরণের সামাজিক ও উন্নয়নমূলক কাজ ২০২০ সাল থেকে অংশীদার হিসেবে অবদান রেখেছে। গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে – নৈশকালীন ঢাকা কোর্ট সাব পোস্ট অফিস সেবা চালু করা, ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণে বিরামহীন মানসম্মত ইন্টারনেট সেবা প্রদান প্রসঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।