সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ পত্র জমা দেওয়া আবশ্যক কিনা - সংবিধানের আলোকে
ব্যারিষ্টার সোহরাওয়ার্দী আরাফাত খান

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ পত্র জমা দেওয়া আবশ্যক কিনা – সংবিধানের আলোকে

ব্যারিষ্টার সোহরাওয়ার্দী আরাফাত খান: সাংবিধানিক সংকট বলতে বোঝায় একটি এমন পরিস্থিতি যেখানে সংবিধানের মধ্যে থাকা আইনসমূহ বা বিধানগুলো কোনো সুনির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়, বা যেখানে সংবিধান অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৭(ক) অনুচ্ছেদ মতে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে তাকে অবশ্যই রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিতে হবে। কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ না করে দেশ ত্যাগ করলে সেই ক্ষেত্রে করনীয় কি হবে তা পরিষ্কার ভাবে সংবিধানে উল্লেখ নেই বলে অনেকে মতামত দিচ্ছেন।

মূলত প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ পত্রের অনুলিপি রাষ্ট্রপতি না পাওয়ার প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টি আরও জটিল হয়েছে ও সাংবিধানিক সংকট বিষয়টি আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে। তবে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ মতে রাষ্ট্রপতিকে যে কোনও আইনি জটিলতায় সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাওয়ার ক্ষমতা প্রদান করে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি করেছেন।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়েছে যে – “যদি কোন সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হয় যে, আইনের এইরূপ কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হইয়াছে বা উত্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে, যাহা এমন ধরনের ও এমন জনগুরুত্বসম্পন্ন যে, সেই সম্পর্কে সুপ্রীম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহা হইলে তিনি প্রশ্নটি আপীল বিভাগের বিবেচনার জন্য প্রেরণ করিতে পারিবেন এবং উক্ত বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানীর পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করিতে পারিবেন।”

এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি এইরূপ কোন পদত্যাগ পত্র আছে কিনা তিনি তা যাচাইয়ের জন্য সামরিক সচিব, সামরিক বাহিনীর প্রধান সহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের নিকট পদত্যাগ পত্রের অনুলিপি তলব করলে ও তারা কেউ পদত্যাগ পত্রের অনুলিপি তাকে সরবরাহ করতে পারেন নাই বলে তিনি মন্তব্য করেন।

আরও পড়ুন: যদি রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হয়, তখন পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন কীভাবে?

তাছাড়া রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গত ৬/৮/২০২৪ ইংরেজি তারিখ পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ায় ও প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করায় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮ (৩) মতে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরমার্শ নিয়ে কোন সিদ্ধান্তে পৌছানো সম্ভব নয় বিধায় বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি রেফারেন্সের জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নিকট মতামত চাইলে সাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক শূন্যতা দূর করতে এবং সুষ্ঠু ভাবে নির্বাহী কার্যক্রম পরিচালনা করতে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে বলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত ৮/৮/২০২৪ ইংরেজি তারিখ ০১/২০২৪ নং স্পেশাল রেফারেন্স মূলে মতামত প্রদান করেন।

এই প্রেক্ষিতে বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা সহ সকল উপদেষ্টাগণকে শপথ করান। সংবিধানে এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য সরাসরি কোনো ব্যাখ্যা বা নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকায়, রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১০৬ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ আদালতের মতামত চেয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকারের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করেছেন।

মূলত, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্রের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন এবং আপিল বিভাগের মতামতের ভিত্তিতে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছেন, যা সংবিধানের পরিপন্থী নয়। তাই, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ পত্র না থাকা এবং এর অনুপস্থিতিতে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করা সংবিধানের ৫৭(ক) ধারা লঙ্ঘন করা হচ্ছে না, বরং এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংবিধানগত সমাধানের একটি উপায় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামতের ভিত্তিতে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করেছেন, যা সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার অংশ। এটি প্রমাণ করে যে তিনি সংকট মোকাবেলার জন্য সংবিধান মোতাবেক কাজ করছেন এবং বিচার বিভাগীয় মতামতকে সম্মান করছেন।

তাই এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ভিন্ন মতামত দেওয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং আপিল বিভাগের মতামতের প্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা সহ সকল উপদেষ্টাগনকে শপথ করানো সাংবিধানিক পরিন্থী নয় এবং একই সাথে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র অতীব জরুরি দলিল দস্তাবেজ নয় বলে আমি মনে করি।

লেখক: ব্যারিষ্টার এট ল’ এবং অ্যাডভোকেট।