সংবিধান সংস্কার এর প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিক বাস্তবতা

সংবিধান সংস্কার এর সমীকরণ সহজ না জটিল!

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম: বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের এর পতনের পরে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে স্পিকারের পদত্যাগ, রাষ্ট্রপতি অপসারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুণঃ প্রবর্তন, সংবিধানের ৭ক ও ৭খ অনুচ্ছেদ বাতিল, উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল এর পুনরুদ্ধার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোসহ কয়েকটি বিষয় নিয়ে এক ধরনের সংকট ঘনীভূত হয়েছে। সংবিধান সংশোধন নাকি পুনর্লিখন সেটি আরেকটি বড় সংকট। বিদ্যমান সংকটসমূহের সমাধান বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন বক্তব্য না থাকায় একধরনের সাংবিধানিক জটিল সমীকরণে রয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন।

ছাত্র-জনতা রাষ্টপতি অপসারণ ইস্যুতে ছাত্র-জনতা একাট্রা হলেও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার কারণে আপাতত ওই ইস্যু আলোর মুখ দেখেনি। সংবিধান, জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগসহ অন্যান্য বিষয়ে সংস্কার কমিশন এর কাজ চলমান থাকায় সংবিধানের সংকট সমাধানে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি ১৭ বার সংশোধনী আনা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংশোধনী এসেছে বিগত স্বৈরাচারী হাসিনা রেজিমে এবং তারা সংশোধনী গুলো নিজেদের সুবিধামতো করেছে যাতে জনগনের রায়ের প্রতিফলন ছিল না।

বিশেষ করে ত্রয়োদশ সংশোধনীতে সংবিধানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল, এবং ষোড়শ সংশোধনীতে ৭২ এর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে ফিরিয়ে দেওয়ার বিধান পাস করা সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও উল্লেখযোগ্য।

আরও পড়ুন: নতুন সংবিধান বিতর্ক: সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ও স্থায়িত্বের প্রশ্ন

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন ঘটে।তারপর থেকে রাষ্ট্র সংস্কারে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ০৬ টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। সংবিধান সংস্কার কমিশন তার মধ্যে অন্যতম।

সংবিধান সংস্কার কমিশন হলো ২০২৪ সালে বাংলাদেশ অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি কমিশন যার প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো অতীতের সাংবিধানিক ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা এবং একটি নতুন অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ তৈরি করা। বিদ্যমান সংবিধান বাতিল করে একটি সম্পূর্ণ নতুন সংবিধান প্রণয়ন করাই হলো সংবিধান পুনর্লিখন।

সাধারণত রাজনৈতিক বিপ্লব, যুদ্ধ, গণ-অভ্যুত্থান বা সরকার কাঠামোর বড় ধরনের পরিবর্তনে সংবিধান পুনর্লিখনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। প্রতিটি দেশ বা জাতির সংবিধান মূলত তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক আকাক্সক্ষার দলিল।আজকের লেখার প্রধান আলোচ্য বিষয় সংবিধান পুনর্লিখন নাকি সংশোধন তা আইন ও বিশেষজ্ঞ জনের বিভিন্ন মতামতের উপর গুরুত্বারোপ করে কিছু লেখার চেষ্টা মাত্র।

সংবিধান পুনর্লিখন বা সংশোধন করা প্রসঙ্গে ইতোমধ্যে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে।আমি চেষ্টা করবো কোন দিকের পাল্লাভারী। সংশোধন নাকি পুনর্লিখন? একারনে শিরোনামে পুনর্লিখন বনাম সংশোধন কথাটি হাইলাইট করেছি।তাছাড়া এ বিষয়ে বিশিষ্টজনদের অভিমত, বিদ্যমান আইন, কেস ল এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। কেউ কেউ বলেছেন সংবিধান পুনর্লিখন নয়, সংশোধন করা বাঞ্ছনীয়।

আরও পড়ুন: নতুন সংবিধান বিতর্ক: ১৯৭২ এর সংবিধানের “ত্রুটি”

অনেকে বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগকে স্বাধীন করতে হবে। নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন সভার ক্ষমতার পৃথকীকরণ প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক শাসন উত্তরণের জন্য সাংবিধানিক সংস্কার অতিব গুরুত্বপূর্ণ।বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাচন ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করা এবং রাষ্ট্রের তিন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়গুলো সংবিধান সংস্কার এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক।সংবিধান সংশোধন কোন প্রেক্ষাপটে দরকার তা জানার চেষ্টা করি।বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সংকট চরমে।তাই সংবিধানসহ সবখানে সংস্কার এর প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

সংবিধান হচ্ছে একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার অভিব্যক্তি বা প্রকাশ।সমাজ, রাজনীতি পরিবর্তনশীল।৫ আগস্টের পরে সময়ের সঙ্গে দেখা দেয় নতুন প্রয়োজন ও চাহিদা। তাই কোনো সংবিধানই চূড়ান্ত বা স্থায়ী কিছু নয়। এরও রয়েছে পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা সংশোধন। এমনকি সম্পূর্ণ সংবিধান বাতিল হয়ে নতুন সংবিধান গৃহীত হতে পারে(যেমন-ফ্রান্স)। তবে এর নজির খুব বেশি নেই। সংবিধান সংশোধনও অহরহ ঘটে না। যাইহোক, বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আগস্ট বিপ্লবের পরে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পরে সংবিধান সংশোধনের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে এটা সর্বজন স্বীকৃত।

আরও পড়ুন: নতুন সংবিধান বিতর্ক: ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণয়নের “গলদ”

বাংলাদেশের সংবিধানকে মোটাদাগে ০২ ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম অংশকে বলা যায় প্রিয়েম্বল রাষ্ট্রের ঘোষণাপত্র বা আকাঙ্ক্ষা।বাকি অংশ, সে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষমতাকাঠামো।দ্বিতীয় ভাগ বা ২য় অংশে সংবিধান রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষার বর্ণনা দিয়েছে তার মূলনীতি অধ্যায়ে। সেই মূলনীতি অনুচ্ছেদ ৮(২)অনুযায়ী আদালতের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য নয়। ফলে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি কাগুজে প্রতিশ্রুতিতে পরিণত হয়েছে এবং সরকারের ইচ্ছাধীন।

অন্যদিকে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্মিত ক্ষমতাকাঠামোর সবটুকুই মোটাদাগে মূলনীতির পরিপন্থী। মূলনীতি অধ্যায়ে লিখিত আকাঙ্ক্ষার বিপরীত কার্যক্রম পরিচালনার উপযোগী ও প্ররোচনাপূর্ণ। ফলে বর্তমান ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া নতুন রাষ্ট্র গঠন করা শুধু অসম্ভবই নয়; বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার আমলের সংবিধান ও তার ক্ষমতাকাঠামো বজায় রেখে বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র বা বিপ্লবী সরকার পরিচালিত হবে, ততোদিন তা জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবে।

এসব কারণেই সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামো অংশটুকু বদলে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটার বাস্তবায়ন ঘটুক।যদিও এ পরিবর্তন ব্যাপক ও মৌলিক। একে মোটাদাগে ‘সংশোধন’ বলা যাবে না। ‘সংশোধন’এর পরিবর্তনের ধরন আলাদা ও ব্যাপক। তবে এই পরিবর্তন সংবিধানের সবকিছুই বদলে দেওয়া বা সম্পূর্ণ নতুন করে লেখা নয়। তাই আমরা এই পরিবর্তনকে ‘সংবিধান সংস্কার’বলছি। রাষ্ট্রের বিপ্লবী পরিবর্তনের পরিবর্তে বর্তমান সমাজবাস্তবতা বিবেচনায় রেখে রাষ্ট্র সংস্কারের যে কর্মসূচি আমরা উত্থাপন করেছি, সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

আরও পড়ুন: বাকশাল প্রবর্তন সংক্রান্ত সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট

এখানে উল্লেখ্য যে, প্রত্যেক লিখিত সংবিধানে সংশোধনী সংক্রান্ত বিধান লিপিবদ্ধ থাকে।সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে সব দেশে এক ও অভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। দেশেভেদে তার ভিন্নতা রয়েছে। যেমন-যুক্তরাজ্যে(গ্রেট-ব্রিটেন)সাধারণ আইন তৈরির নিয়মে পার্লামেন্ট সংবিধানের লিখিত অংশের কোথাও সংশোধন বা নতুন কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। অন্যদিকে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে এ পদ্ধতি কিছুটা জটিল ও ‘ভারসাম্য নীতি’ নির্ভর।

সেখানে হয় কংগ্রেসের উচ্চ কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য অথবা অঙ্গরাজ্যসমূহের দুই-তৃতীয়াংশ (২/৩) আইনসভা প্রথমে সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব আনবে। এরপর বিশেষ কনভেনশনের মাধ্যমে বা অন্য উপায়ে অঙ্গরাজ্যসমূহের আইনসভার তিন-চতুর্থাংশের (৩/৪) অনুসমর্থনে সংশোধনী পাস ও কার্যকর হয়। কোনো কোনো দেশে এ জন্য জনমত যাচাই বা রেফারেন্ডামের বিধান আছে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে সংবিধান সংশোধনের সুনির্দিষ্ট নিয়ম বা পদ্ধতি উল্লেখিত রয়েছে। সে অনুযায়ী জাতীয় সংসদকেই এর উদ্যোগ নিতে হয়। এরপর যেসব শর্ত বা নিয়ম পালন করতে হয়, সংক্ষেপে তা নিম্নরূপ—

ক. বিলের সম্পূর্ণ শিরোনাম: সংশোধনীর জন্য আনীত বিলের সম্পূর্ণ শিরোনাম এবং সে শিরোনামে সংবিধানের কোন বিধান সংশোধন করা হবে, তা স্পষ্টরূপে উল্লেখ থাকতে হবে। অন্যথায় বিলটি বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা যাবে না।

খ. দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত: বিলটি সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত হতে হবে।

গ. রাষ্ট্রপতির সম্মতি: উপরিউক্ত উপায়ে কোনো বিল গৃহীত হওয়ার পর সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট তা উপস্থাপিত হবে। উপস্থাপনের সাত দিনের মধ্যে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করবেন এবং কোনো কারণে তিনি তা করতে অসমর্থ হলে উক্ত মেয়াদের অবসানে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করেছেন বলে গণ্য হবে।

আরও পড়ুন: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরাতে তিন আবেদনের শুনানি ১৭ নভেম্বর

ঘ. গণভোটের বিধান (রেফারেন্ডাম): সংবিধানের প্রস্তাবনা অথবা অনুচ্ছেদ ০৮ (রাষ্ট্রীয় মূলনীতি), অনুচ্ছেদ ৪৮(রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, তাঁর ক্ষমতা ও মর্যাদা) বা অনুচ্ছেদ ৫৬ (প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগদান) সংক্রান্ত কোনো সংশোধনী বিল নিয়ম অনুযায়ী গৃহীত হওয়ার পর সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপনের সাত দিনের মধ্যে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করবেন কি করবেন না, এ প্রশ্নটি গণভোটে প্রেরণের ব্যবস্থা করবেন।১৯৭৮ সালে এক আদেশ বলে জেনারেল জিয়াউর রহমান গণভোটের এ নিয়ম করেন, যা পরবর্তীকালে পঞ্চম সংশোধনীর অন্তর্ভুক্ত হয়।

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়ে যে সকল সংশোধনী আনতে পারে তা হলো-

ক. সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংযোযিত ৭(ক) এবং (খ) নং অনুচ্ছেদ রিপিল করতে হবে।

খ. রাষ্ট্রীয় মূলনীতি তথা ২য় ভাগে থাকা অনুচ্ছেদ ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৮(ক), ২০, ২২-নং অনুচ্ছেদ গুলোকে স্থানান্তর করে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

গ. প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ করে সব মিলিয়ে কোনো ব্যক্তি দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বপালন করতে পারবেন না। সাংবিধানিক পদসমূহে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি ‘সাংবিধানিক কলেজিয়াম’ দায়িত্ব পালন করবে। ফলে এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতা রোধ করা সম্ভব হবে।

ঘ. উপ-প্রধানমন্ত্রী পদ প্রবর্তন করা যেতে পারে।

ঙ. ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বা ফ্লোর ক্রসিং সিস্টেম সংশোধন করে একে আরও গণতান্ত্রিক করা যায়।

চ. অনুচ্ছেদ ৭৭ নং এ থাকা ন্যায়পালকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে পূর্ণরূপে কার্যকর করা।

ছ. রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ প্রণয়ন ক্ষমতাকে সরকারগুলো অপব্যবহার করে থাকে। জরুরি গুরুত্বপূর্ণ আইন ছাড়াও সংসদের বিকল্প হিসেবে যখন-তখন অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন করা হয়। ফলে তা সংসদকে পাশ কাটানোর একটি কৌশল হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ফলে কেবল জরুরি আর্থিক বা বাজেট সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া অধ্যাদেশ প্রণয়ন ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা প্রয়োজন।

জ. সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ত্বরিৎ পুনর্জীবন ঘটিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা অর্পণ এবং পাশাপাশি উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ আইন প্রণয়ন করতে হবে।

ঝ. বাহাত্তরের সংবিধানের ১১৬ নম্বর অনুচ্ছেদ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ ছিল। যেখানে সুপ্রিম কোর্টের ওপর অধস্থন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে এই ১১৬-এ অনুচ্ছেদটি পরিবর্তন করে অধস্থন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় সরকারের ওপর। বিগত ৫৩ বছরে কয়েকটি সরকার ক্ষমতায় এসে সংবিধানের ১৭টি সংশোধনী এনেছে, কিন্তু কেউই ১১৬ নম্বর অনুচ্ছেদকে এর মৌলিকরুপে ফেরত আনেনি। তাই এই অনুচ্ছেদটির পুনর্বহাল করা আবশ্যক তাতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ এবং পৃথক পূর্ণাঙ্গ বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা সহজ হয়।

আরও পড়ুন: সংবিধানের ত্রয়োদশ ও ষোড়শ সংশোধনীসহ গুরুত্বপূর্ণ মামলায় দৃষ্টি থাকবে সুপ্রিম কোর্টে

এটা সুস্পষ্ট যে, সংবিধান সংশোধনযোগ্য। দুই–তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্য চাইলে নিয়ম মেনে সংবিধানের যেকোনো অংশই সংশোধন করা যায়। বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের ০৪টি দিক রয়েছে। এর প্রথম ০৩টি সংবিধানের সাধারণ কোনো বিষয় সংশোধনীর জন্য অনুসরণ করতে হয়। আর প্রস্তাবনার মতো মৌলিক বিষয় সংশোধনীর জন্য এর সঙ্গে গণভোটের শর্ত পূরণ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে উচ্চ আদালত সংবিধানের রক্ষক। সংবিধানের কোনো সংশোধন সংবিধানসম্মত কি না, তা যাচাই করার দায়িত্ব উচ্চ আদালতের। বাংলাদেশের সংবিধান বিভিন্ন সময়ে সংশোধিত হয়েছে। বেশ কয়েকটি সংশোধনী উচ্চ আদালত বাতিলও করেছেন।

আমরা ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্টের আন্দোলনকে যে নামেই অভিহিত করার চেষ্টা করি না কেন, এটি একটি সফল আন্দোলন। এই বিপ্লবের কারণে মানুষের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো জেঁকে বসা স্বৈরাচারী শাসক ও তার দোসরদেরকে দেশ থেকে পালাতে হলো। আন্দোলনের ফলে ফ্যাসিস্ট সরকারকে সরানো হলো, এটি হলো সাংবিধানিক অধিকার।সব অধিকার বইয়ে লেখা থাকে না।

বিগত পতিত স্বৈরাচার সরকার ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে নিজেদের মতো করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করে। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা হয়েছিল। তার আগে নির্বাচনের জন্য কোন গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা ছিল না। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় দু’তিনটি নির্বাচন ভালোই হয়েছিল। পরে সেটি আবার বাতিল করা হলো।সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এসব কারনে খুব বেশি প্রয়োজন। যেগুলো না করলেই নয়, যেমন বিচার বিভাগকে পুরোপুরি স্বাধীন করা ইত্যাদি।

১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে দেশ স্বাধীন হলো, ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেলাম। কিন্তু কী পেলাম পরবর্তী সময়ে? ফলাফল মোটেও ভালো নয়।০৫ আগস্ট ও তার পূর্ববর্তী সময়ে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা যদি এগিয়ে না আসত, তাহলে যে গর্তে পড়েছিলাম, সেখানেই থাকতে হতো।আগের সংবিধানটাই সংশোধন করাই বাঞ্ছনীয়। কেননা, আগেরটির মধ্যে অনেক মূল্যবান বক্তব্য আছে। সোনালী অতীত ও ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি রয়েছে। এটিকে আরো গণতান্ত্রিক করা, আরো জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের ফ্যাসিস্ট সরকার না আসে, যারা সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে না পারে-এ জন্য সংশোধন দরকার।

আরও পড়ুন: সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী মামলায় পক্ষভুক্ত হলেন ইনসানিয়াত বিপ্লবের চেয়ারম্যান

সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন হবে কি না, তার সিদ্ধান্ত নিতে সংবিধান সংস্কার কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করছে।এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. আলী রিয়াজ (কমিশনের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার আগে) সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ আয়োজিত এক সম্মেলনে বলেন, সংবিধান সংশোধনের উপায় নেই। বর্তমান সংবিধান সংশোধনের উপায় সীমিত। কারণ, সংবিধানের এক–তৃতীয়াংশ এমনভাবে লেখা যে তাতে হাতই দেওয়া যাবে না। এর মধ্যে এমন সব বিষয় আছে, যেগুলো না সরালে কোনো কিছুই করতে পারবেন না। এ কারণে পুনর্লিখন শব্দটা আসছে। পুনর্লিখনের পথ হিসেবে গণপরিষদের কথা বলছি।

অপরদিকে ড. হাফিজুর রহমান কার্জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বলছেন সংবিধান চাইলেই পুনর্লিখন করা যায় না।সংশোধন করে সময়োপযোগী করা যায়।

এখন দেখা যাক সংবিধান সংশোধন হচ্ছে নাকি পুনর্লিখন তা সময় বলে দিবে। এখনো ও যেহেতু সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান সংস্কারে কাজ করছে তাই এই আশা করতেই পারি যে, অধিকাংশ জনগণ যেটা চায় সে পথেই হাটবে সংবিধান সংস্কার কমিশন।তখন নির্ধারিত হবে সংবিধান সংশোধন হবে নাকি পুনর্লিখন হবে। সাংবিধানিক সংকট সমাধানে ততক্ষণ কমিশনের সুপারিশ না আসা অবধি অপেক্ষা করতে হবে।

লেখকঃ মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম (পিএইচডি ফেলো), সংবিধান গবেষক ও কলামিস্ট। Email-bdjdj1984du@gmail.com