বাংলাদেশে আইনগত সহায়তা প্রদান সেবার (Legal Aid Services) সংস্কার বিষয়ক প্রস্তাব: আমার নিজস্ব ভাবনা
ছগির আহমেদ; মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, সিলেট

চৌকি আদালত: ইতিহাস, বর্তমান পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে চৌকি আদালত (Chowki Adalat) একটি বিশেষ ধরনের আদালত যা মূলত দেশের প্রান্তিক এলাকায় প্রতিষ্ঠিত। এই আদালতটি উপজেলা পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং এটি ফৌজদরী ও দেওয়ানী মামলার বিচার করে। চৌকি আদালতের ইতিহাস বেশ পুরনো এবং এটি মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বিচার ব্যবস্থার উত্তরাধিকারী। বর্তমানকালে, চৌকি আদালত বলতে নির্দিষ্ট উপজেলা সমূহে অবস্থিত সিনিয়র সহকারী জজ আদালত এবং সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতকে বুঝায়।

ইতিহাস ও ভূমিকা

চৌকি আদালতের যাত্রা শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে, যখন ১৮৮০ সালে ব্রিটিশ সরকার চৌকি আদালত স্থাপন করে। এটি গঠিত হয়েছিল মূলত জমিদারি ব্যবস্থার সমস্যাগুলি সমাধান করার জন্য, বিশেষ করে খাজনা আদায় সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য। ব্রিটিশ আমলে এই দুই আদালত একজন মুন্সেফ ও ম্যাজিস্ট্রেট পরিচালনা করতেন। ব্রিটিশ আমল ছাড়াও পরবর্তীকালে যোগাযোগ ব্যবস্থায় দুর্গম এলাকাগুলোতে এ ধরনের আরও কিছু আদালত স্থাপিত হয় ও পূর্বাপর কিছু আদালত জেলা সদরে আনা হয়। চৌকি আদালতের মাধ্যমে, বিশেষ করে দুর্গম এলাকায়, বিচার বিভাগের সেবা জনগণের কাছে পৌঁছানোর একটি কার্যকরী ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে।

বর্তমান অবস্থা

আজকের দিনে, চৌকি আদালত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং বিশেষত দুর্গম অঞ্চলে কাজ করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ১৬টি জেলায় ৪৩টি চৌকি আদালত রয়েছে, যার মধ্যে ২৫টি ফৌজদারী এবং ১৮টি দেওয়ানী আদালত। এর মধ্যে শুধু চট্টগ্রাম জেলায়ই ৭টি উপজেলায় চৌকি আদালত রয়েছে।

চৌকি আদালতে বিদ্যমান সমস্যা

দেশের চৌকি আদালতগুলো বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। সামগ্রিক বিচার বিভাগ যেমন বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন, তেমনই চৌকি আদালতগুলোও এর বাইরে নয়। এসব আদালতের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অবকাঠামোগত সংকট। আসলে শুধু চৌকি আদালত নয়, দেশের বেশিরভাগ বিচার বিভাগের ভবনই জরাজীর্ণ এবং নাজুক অবস্থায় রয়েছে। কিছু চৌকি আদালতের নিজস্ব ভবন নেই, তারা ভাড়া করা ভবনে আদালত পরিচালনা করছে। এসব আদালতের ভবনগুলোর অবস্থা এতটাই খারাপ যে, এজলাস পরিচালনার সময় নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়।

চৌকি আদালতগুলোর আরেকটি বড় সমস্যা হলো পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব। কয়েকটি আদালতে কম্পিউটার, প্রিন্টার বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সংকট রয়েছে। সারা দেশের আদালতগুলোর মতো চৌকি আদালতগুলোর বাজেটও খুবই সীমিত। বেশিরভাগ চৌকি আদালতে বিচারকদের জন্য সরকারি আবাসন সুবিধা বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। জেলা আদালতে কর্মরত বিচারকদের জন্য কিছু পরিবহন সুবিধা থাকলেও, চৌকি আদালতের বিচারকদের জন্য কোনো পরিবহন ব্যবস্থা নেই। ফলে তারা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করতে না পারায়, আদালতে আসা-যাওয়ার পথে নিরাপত্তাহীনতার শিকার হচ্ছেন। অনেক সময় রিকশা, ভ্যান বা পায়ে হেঁটে চলাচল করতে গিয়ে বিচারকদের মর্যাদাহানি ঘটছে।

এছাড়া, কোনো পরিবহন সুবিধা না থাকার কারণে চৌকি আদালতে কর্মরত বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট সরেজমিনে গিয়ে জুডিসিয়াল ইনক্যয়ারি বা বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত বা পরিবেশ আদালত (স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত) পরিচালনা করতে পারছেন না। এর ফলে বিচারপ্রার্থী জনগণ প্রয়োজনীয় ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চৌকি আদালতের এইসব সমস্যা সমাধান না হলে, দেশের বিচার ব্যবস্থা আরো দুর্বল হবে এবং জনগণের মধ্যে আস্থা কমে যাবে।

চৌকি আদালতে মামলা জট

চৌকি আদালতগুলোর একটি প্রধান সমস্যা হচ্ছে মামলা জট। বর্তমানে, দেশের বিভিন্ন চৌকি আদালতে বিপুল সংখ্যক মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বিশেষত, চট্টগ্রামের সাতটি উপজেলায় অবস্থিত চৌকি আদালতে প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি মামলা দীর্ঘদিন ধরে বিচারাধীন রয়েছে। সার্বিকভাবে, প্রায় ৮০ হাজার দেওয়ানি এবং ৪০ হাজার ফৌজদারি মামলা দেশের চৌকি আদালতগুলোতে জমে আছে। এই মামলা জট বিচারপ্রার্থীদের জন্য বিরাট একটি সমস্যা সৃষ্টি করছে, যার ফলে ন্যায্য বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব হচ্ছে এবং বিচার ব্যবস্থার উপর জনবিশ্বাস ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

সমাধান ও পরামর্শ

চৌকি আদালতের সমস্যা সমাধানের জন্য বিচার ব্যবস্থায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রথমত, চৌকি আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। সেই লক্ষ্যে প্রত্যেক চৌকি আদালতে জুডিসিয়াল কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, চৌকি আদালতের বিচারকদের জন্য আবাসন সুবিধা, উপযুক্ত পরিবহন ব্যবস্থা এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি, তাদেরকে যথাযথ লজিস্টিক সাপোর্ট প্রদান করতে হবে। তৃতীয়ত, চৌকি আদালতের বিচারকদের সুস্থ ও উপযুক্ত পরিবেশে কাজ করার সুযোগ প্রদান করতে হবে, যাতে তারা তাদের কাজটি আরও দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে পারেন। চতুর্থত, মামলার নথিপত্র ডিজিটাল করার ব্যবস্থা, ভার্চুয়াল শুনানির ব্যবস্থা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে যা বিচার প্রক্রিয়াকে দ্রুত এবং স্বচ্ছ করবে।

উপসংহার

চৌকি আদালত বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার অঙ্গ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে, বিশেষ করে দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের জনগণের জন্য। তবে, চৌকি আদালতগুলো বর্তমানে নানা সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, যা তাদের কার্যকারিতা ও সক্ষমতাকে সীমিত করে দিয়েছে। এসব সমস্যার সমাধানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিচারকদের জন্য আবাসন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, লজিস্টিক সাপোর্ট বৃদ্ধি, এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার প্রয়োজন। শুধুমাত্র এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে চৌকি আদালতের কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী এবং জনগণের জন্য আরও কার্যকরী করে তোলা সম্ভব হবে, যা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় জনগণের আস্থা ও ন্যায্যতার প্রতীক হয়ে উঠবে।