মোঃ ওবাইদুল্যাহ আল মামুন সাকিব : বর্তমান সংবিধানের ২২ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচারবিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।” স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে বিচার বিভাগ স্বাধীন এবং পৃথককরণের জন্য সুস্পষ্ট অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করেছে। সাংবিধানিকভাবে বিচার বিভাগ স্বাধীন করা হলেও বাস্তবে স্বাধীনতা কোন রাজনৈতিক সরকার নিশ্চিত করতে পারেনি বা নিশ্চিতকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে নি যা নাগরিকদের প্রকৃত ন্যায় বিচারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
স্বাধীনতার ২৩ বছর পর বাংলাদেশে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার জন্য ১৯৯৪ সালে রীট মামলা দায়ের করেছিলেন প্রাক্তন জেলা ও দায়রা জজ মাসদার হোসেন। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার রীট মামলায় সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে চূড়ান্ত রায় দেয়া হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ২রা ডিসেম্বর। সর্বোচ্চ আদালত বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ মামলায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নির্দেশনা ছিল যে, “বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করতে হবে।”
চূড়ান্ত রায় প্রকাশ হওয়ার আট বছর পর ওয়ান ইলেভেন সরকারের তৎকালীন আইন ও বিচার উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের সার্বিক সহযোগিতায় ২০০৭ সালে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণের নির্দেশনাটি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহন করেন। ০১ লা নভেম্বর ২০০৭ সালে তৎকালীন ফখরুদ্দিন-মঈন উদ্দিনের ১/১১ এর সরকার বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে যার ফলে বিচারিক আদালত তুলনামূলক পৃথক হয়ে ন্যায় বিচার নিশ্চিতে মনোনিবেশ করে।
রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণেও রাষ্ট্রের এই তিনটি বিভাগ কখনোই পুরোপুরি আলাদাভাবে কাজ করতে পারে না। এক্ষেত্রে প্রয়োজন পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সমন্বয় এবং ভারসাম্যের। এই ভারসাম্যের নীতি দ্বারাই আধুনিক রাষ্ট্র কাঠামো নির্ভর করে। এই নীতির প্রধান শর্ত হলো, একটি বিভাগ আরেকটি বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না বরং পরস্পর সহযোগী হয়ে নাগরিকদের জন্য দ্বায়িত্ব পালন করবে।
আরও পড়ুন: বিচার বিভাগ সংষ্কার কমিশনের সংবিধান লঙ্ঘন এবং আদালত অবমাননা
বর্তমান বাংলাদেশে আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্ম্য চরম আকার ধারণ করছে। স্বাধীন বিচার বিভাগ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সকল রাজনৈতিক সরকার এই দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছে কিংবা অনেকেই চাইলেও আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্ম্যে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হননি। ফলে নাগরিকগন ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
বিচার প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য বিচারকদের প্রধানতম দায়িত্ব হওয়ার কথা। আর এই দায়িত্ব পালনে চৌকস, প্রজ্ঞাবান এবং আইন বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা বিচারকই সঠিক দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম। রাষ্ট্র কাঠামোর গ্রহণযোগ্যতার সাথে ন্যায় বিচারের সংস্কৃতি ওতোপ্রোতোভাবেই জড়িত। ন্যায় ভিত্তিক সমাজ বিনির্মানে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে বিচার-কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।’ আইন বিষয়ে বিশেষায়িত জ্ঞান না থাকলে সঠিকভাবে বিচার করা যায় না। তাছাড়া বিচার করা একটি জটিল ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজও বটে। একটি সংবেদনশীল কাজ হিসেবে বিচার প্রক্রিয়ায় বিচার বিভাগে কর্মরত বিচারকদের কাছেই ছেড়ে দেয়া উচিত। অন্যথায় স্বাভাবিকভাবেই পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকার দরুন ন্যায় বিচার বিঘ্নিত হবে।
অপরদিকে গণতান্ত্রিক দেশে আমলাদের প্রধান কাজ হলো নির্বাচিত সরকার কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা। বৃটিশ সাম্রাজ্যের শুরু থেকেই আমলাতান্ত্রিক কাঠামোয় জনগণ পরিবেষ্টিত। স্বাধীন বাংলাদেশেও আমলাতান্ত্রিক কাঠামো থেকে রাষ্ট্র কাঠামো বের হতে পারেনি বরং প্রতিটি নির্বাহীসহ অন্যান্য কার্যাবলিতে আমলারা সরকারের আদেশ-নির্দেশের ওপর নির্ভরশীল। ফলে স্বভাবতই আমলাদের পক্ষে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকে না। বিচার প্রক্রিয়ায়ও আমলারা নির্বাহী বিভাগের করায়ত্তে থাকায় এবং আইন বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায় বিচারকার্য পরিচালনায় আমলারা স্পষ্টতই অযোগ্য এবং অগ্রহণযোগ্য।
আরও পড়ুন: সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ জারি এবং বাস্তবতার নিরিখে সমালোচনা
স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর ২০০৭ সালে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে কাগজে কলমে পৃথক হয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সরাসরি জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে আইন বিষয়ে নূন্যতম স্নাতক, এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারীরাই তুলনামূলক প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রাপ্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে দ্রুত এবং অধিকতর গ্রহণযোগ্য নিয়োগের জন্য যোগ্যতার মাপকাঠি বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
যেমন নূন্যতম ০৭ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আইনজীবী বিচারক নিয়োগের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ নিশ্চিত করলে নাগরিকগন অধিক সুবিধা ভোগ করতে পারে। তবুও বর্তমান নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আইন বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা ব্যক্তি যখন বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছে তিনি আমলাদের চেয়ে বহুলাংশে অগ্রসরমান এবং ন্যায় বিচার নিশ্চিতে বদ্ধপরিকর।
প্রশ্ন হলো, বর্তমান জনপ্রশাসন সংষ্কার কমিশন মাসদার হোসেন বনাম বাংলাদেশ মামলার সেটেলড বিষয়টি কোন উদ্দেশ্যে উত্থাপন করেছে? বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবীগণ বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য মাসদার হোসেন মামলায় লড়াই করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় যে, বিপ্লব পরবর্তী গঠিত জনপ্রশাসন সংষ্কার কমিশনের সুপারিশগুলো পুনরায় বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের নিকট ন্যাস্ত করছে যা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২২, ১১৬ক এবং মাসদার হোসেন বনাম বাংলাদেশ মামলার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা, নাগরিকদের জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা, আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্ম্য বন্ধ করা, নাগরিক এবং বিচার বিভাগের উপর পারস্পরিক আস্থা, শ্রদ্ধাবোধ এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিতে বিচার বিভাগকে অবশ্যই পৃথক রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের অধীনে বিচারিক আদালতকে সরাসরি তত্বাবধান করতে হবে। বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আইনজীবীদেরকে প্রাধান্য দিতে হবে। নাগরিকদের অনুভূতি বোঝার সক্ষমতা প্রত্যেক বিচারককে নিশ্চিত করতে হবে। তবেই একটি ভারসাম্য, ন্যায়ানুগ এবং গ্রহণযোগ্য বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা পাবে।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক এবং অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।