আইন শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন দেখভালের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্থায়ী ও স্বতন্ত্র আইন শিক্ষা বোর্ড থাকা উচিত বলে মনে করে বিচার বিভাগের সংস্কার কমিশন। কমিশনের ২৮ দফা সুপারিশের মধ্যে আইন শিক্ষা সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে। বিষয়টি কমিশনের ২৪ নং সুপারিশে স্থান পেয়েছে।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে আইন শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন দেখভাল করার জন্য একক কোন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এবং আইন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটা সমন্বয়হীনভাবে আইন শিক্ষা পরিচালনা করে থাকে। আইন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়: সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইন বিভাগ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইন বিভাগ এবং আইন কলেজ।
বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ৩৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৮২টি আইন কলেজ প্রাতিষ্ঠিনাকি ভাবে আইন স্নাতক (সম্মান) ও পাস ডিগ্রি প্রদান করছে। এই তিন ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে প্রদত্ত আইন শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যাপূর্নক্ষেত্র বিভিন্ন গবেষণায় চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- সমন্বয়হীন পাঠ্যসূচি
- আইন শিক্ষার জন্য যোগ্য শিক্ষার্থী বাছাই
- আইন শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে উৎসাহিত না করে চাপিয়ে দেওয়া
- আইন শিক্ষায় ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব
এসব সমস্যা লাঘবের জন্য বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন নিম্নরূপ প্রস্তাব করছে:
আইন শিক্ষা বোর্ড
আইন শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন দেখভালের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্থায়ী ও স্বতন্ত্র আইন শিক্ষা বোর্ড থাকা উচিত। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে উক্ত বোর্ড আইন শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে। উক্ত আইন শিক্ষা বোর্ডের গঠন নিম্নরূপ হতে পারে:
১. জেলা আদালতের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, চেয়ারম্যান
২. আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, সদস্য
৩. বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের একজন প্রতিনিধি, সদস্য
৪. বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের একজন প্রতিনিধি, সদস্য
৫. বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক মনোনীত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন আইনের অধ্যাপক, সদস্য
৬. বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক মনোনীত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন আইনের অধ্যাপক, সদস্য
বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন (সম্মান) কোর্সে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা
আইন শিক্ষা বোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আইন (সম্মান) কোর্সে ভর্তি এবং ভর্তি পরীক্ষার নীতিমালা প্রণয়ন করে এক বা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করবে। উক্ত নীতিমালায় যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে:
- ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আবেদনের যোগ্যতা
- ভর্তির জন্য প্রার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়া
- মেধা তালিকা প্রকাশ: ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের মধ্য থেকে সরকারি/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন (সম্মান) কোর্সে ভর্তির জন্য জাতীয় মেধা তালিকা প্রকাশ করা হবে। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সর্বনিম্ন নম্বর নীতিমালা দ্বারা নির্ধারিত হবে।
- কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুমোদিত আসনের অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে না। অনুমোদিত আসনের অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিধান থাকবে।
অনুরূপভাবে, আইন শিক্ষা বোর্ড ল কলেজগুলোতে ভর্তির সমন্বিত একটি পদ্ধতি প্রচলনের ব্যবস্থা করবে যাতে ভর্তিচ্ছুদের ন্যূনতম মান বজায় রাখা যায়।
পাঠ্যসূচি আধুনিকায়ন
অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সিলেবাস অত্যন্ত ব্যাপক। এ ধরনের সিলেবাস শিক্ষার্থীদের উপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতিরিক্ত জিইডি কোর্সের বাইরেও অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ আইন বিষয়ক কোর্স পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অতিরিক্ত কোর্সের চাপে শিক্ষার্থীরা আইন বিষয়ে গভীর জ্ঞানার্জনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। আইন শিক্ষার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কোর্সের চাপ কমাতে হবে। আইন শিক্ষার ব্যবহারিক দিকটির উপর আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কোর্ট ভিজিট, মুটিং, ল ক্লিনিকের পাশাপাশি গবেষণার উপরও গুরুত্ব দিতে হবে। কম্যুনিটি লিগ্যাল সার্ভিস, সমসাময়িক আইনের তাত্তি¦ক ও ব্যবহারিক দিক নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের মতবিনিময় সভা, সেমিনার, ওয়ার্কশপ নিয়মিত আয়োজন করা উচিত। স্নাতক পর্যায়ে আইন শিক্ষায় আধুনিক কিছু কোর্স পড়ানো উচিত, যেমন: সাইবার আইন, ফরেনসিক ও বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য, আদালত ও মামলা ব্যবস্থাপনা, লিগ্যাল ও প্রফেশনাল এথিকস এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি।
আইন শিক্ষার মাধ্যম
বাংলাদেশের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগগুলোতে ছাত্রদের পরীক্ষায় ইংরেজিতে উত্তর দিতে বাধ্য করা হয়। এতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষণ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং আইন শিক্ষার মান কমছে। আইন শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে উৎসাহিত করা যেতে পারে, কিন্তু বাধ্য করা উচিত নয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে আইন শিক্ষা
মৌলিক মানবাধিকার সম্পর্কে অজ্ঞতা, আদালতের কার্যক্রম সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা এবং সর্বোপরি আইন ও আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মনে প্রোথিত। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মাধ্যমিক শ্রেণিতে বিভিন্ন বিষয়ে আইন ও মানবাধিকার বিষয়ক নিবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে আইন একটি পূর্ণ বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।