সুপেয় পানিপ্রাপ্তি ‘মৌলিক অধিকার' বটে

সুপেয় পানিপ্রাপ্তি ‘মৌলিক অধিকার’ বটে

এক যুগেরও অধিক সময় পূর্বে ২০১৩ সালে ৫০০ বিজ্ঞানী আশঙ্কা প্রকাশ করিয়া বলিয়াছিলেন যে, এমন একটা সময়ের আবির্ভাব ঘটিবে, যখন মানুষে-মানুষে, গোত্রে গোত্রে এবং সর্বোপরি চূড়ান্ত পর্যায়ে রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে সংঘাত লাগিয়া যাইবে। সেই সংঘাত বা সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটিবে কোনো অঞ্চল বা সার্বভৌম সীমান্ত দখলের ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া নহে, বরং পানির কারণে—বিশুদ্ধ পানির সংকটে!

বিজ্ঞানীদের দাবি, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে পড়িবে বিশ্বের অর্ধেক মানুষ। ঐ গবেষণায় বলা হয়, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সেই পানিসংকটের প্রথম লক্ষণ হইবে, মানুষ যেই সকল এলাকায় পানি পাইবে না, সেই সকল এলাকা হইতে গণহারে অন্যত্র চলিয়া যাইবে বা যাইতে বাধ্য হইবে। বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, সরকারগুলির ব্যর্থতার কারণেই এহেন পরিণতি ঘটিতে পারে। তাহারা দেখিতে পাইয়াছেন, পানি এমন একটি মারাত্মক বিষয় হইয়া উঠিতে চলিয়াছে যে, একবিংশ শতাব্দীতে বৈশ্বিক মানব উন্নয়নকেও বাধাগ্রস্ত করিবে।

প্রশ্ন হইল, বিশ্বের সেরা ৫০০ বিজ্ঞানী সরকারগুলিকে যেই আশঙ্কার কথা শুনাইয়াছিলেন, তাহা কি সংশ্লিষ্টদের কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌছাইয়াছে? আমাদের ন্যায় উন্নয়নশীল সরকারগুলি যে এই ধরনের সতর্ক সংকেত থোড়াই কেয়ার করে তাহাতে দ্বিমত নাই! এই জনপদে সুপেয় পানির সংকটজনিত সমস্যা দীর্ঘ দিনের। তথাপি সুপেয় পানি নিশ্চিতে যথেষ্ট ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে আমাদের বড় ধরনের উদাসীনতা রহিয়াছে।

রাজধানী ঢাকায় সুপেয় পানির সংকট দিনে দিনে চরম মাত্রায় অসহনীয় হইয়া উঠিতেছে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলিতেও সুপেয় পানির জন্য হাহাকার। সাম্প্রতিক এক জরিপে জানা যায়, বাংলাদেশের প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্যে দুইটি, অর্থাৎ ৩৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ দূষিত উৎসের পানি পান করিয়া থাকে। একইভাবে বিভিন্ন অণুজীবযুক্ত পানি পানকারীর সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি! বলা বাহুল্য, এই অবস্থা চলিতে থাকিলে নাগরিক স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয়টি একটি সময়ে আসিয়া নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া যাইতে পারে।

আরও পড়ুননিরাপদ পানিকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করে হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়

কিন্তু এই আশঙ্কার মধ্যেও আমাদের জন্য আশার সংবাদ রহিয়াছে! গত বৃহস্পতিবার মহামান্য হাইকোর্ট একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী রায়ে নিরাপদ খাবার ও ব্যবহারযোগ্য পানিকে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ‘মৌলিক অধিকার’ হিসাবে ঘোষণা করিয়া স্পষ্টভাবে জানাইয়া দিয়াছেন যে, বাংলাদেশ সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপদ এবং বিশুদ্ধ পানযোগ্য পানির অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

আদালতের নির্দেশনায় বলা হয়, এক বৎসরের মধ্যে বাংলাদেশের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক স্থান, অর্থাৎ আদালত, ধর্মীয় উপাসনালয়, হাসপাতাল, রেল স্টেশন, হাটবাজার, এয়ারপোর্টসহ পাবলিক প্লেসগুলোতে নিরাপদ পানযোগ্য পানি নিশ্চিত করিতে হইবে। আদালতের এই ঐতিহাসিক রায়কে আমরা সাধুবাদ জানাই। রায়টি বাস্তবায়িত হইলে দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী উপকৃত হইবে এবং পানিবাহিত রোগবালাই হইতে মানুষ রক্ষা পাইবে।

এই রায় আরো একটি কারণে প্রশংসার দাবি রাখে। রায়ে ২০২৬ সালের মধ্যে সকল পাবলিক প্লেসে বিনা মূল্যে নিরাপদ পানি সরবরাহে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইয়াছে—সেই মর্মে একটি রিপোর্ট আদালতে দাখিল করিবার জন্য নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। পাশাপাশি হাইকোর্ট কর্তৃক ঘোষিত তুরাগ নদের রায়, সোনারগাঁওয়ের রায় এবং হাতিরঝিলের রায়ের নির্দেশনাগুলিও এই রায়ের নির্দেশনার অন্তর্ভুক্ত হইবে।

সহজ করিয়া বলিলে, আমাদের পানির উৎসগুলি যাহাতে ক্ষয়িষ্ণু না হয়, তথা পানি শুকাইয়া না যায়, পানি অনিরাপদ না হয়, পানি দূষিত না হয়—তা নিশ্চিত করিবার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। মোদ্দা কথা, সরকার আদালতের নির্দেশ কতটা পালন করিতেছে, তাহাও মনিটরিং করিতেছে আদালত।

অর্থাৎ, বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিতে সরকারকে একটি জবাবদিহিতার আওতায় আনিয়াছে হাইকোর্ট। ইহাতে ইতিবাচক ফলাফল প্রাপ্তির পথ সুগম হইবে। তবে সুপেয় পানির এই সংকট উত্তরণে জনগণকেও আন্তরিক হইতে হইবে, হইতে হইবে ‘পরিণামদর্শী’। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ‘অস্তিত্বের এই সংকট’ কাটিয়া যাউক।

সূত্র : ইত্তেফাক