দীপজয় বড়ুয়া : কোনো অন্যায় বা বেআইনি কর্মকাণ্ডের দ্বারা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার আছে। এ কারণে মামলা–মোকদ্দমার প্রয়োজন হয়। কিন্তু অনেক সময় কাউকে হয়রানি বা সামাজিকভাবে হেয় করতেও মামলা করা হয়। অনেকে আবার মিথ্যা সাক্ষ্যও দিয়ে থাকেন। মিথ্যা মামলা করা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া—দুটিই ফৌজদারি অপরাধ এবং এর জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে।
সাধারণ অর্থে বলা যায় যে, যদি কোন লোক কোন শপথক্রমে বা আইনে কোন প্রকাশ্য বিধান অনুসারে সত্য বলতে আইনতঃ বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও, অথবা কোন বিষয়ে একটি ঘোষণা প্রদান করতে আইনানুসারে বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও, এমন কোন উক্তি করে বা বিবৃতি দান করে যা মিথ্যা, এবং যা হয় সে মিথ্যা বলে জানে, না হয় সে মিথ্যা বলে বিশ্বাস করে অথবা যা সে সত্য বলে বিশ্বাস করেনা, তবে উক্ত লোক মিথ্যা সাক্ষ্য দান করে বলে গণ্য হয়।
ব্যাখ্যা ১: কোন উক্তি বা বিবৃতি মৌখিকভাবে অথবা অন্য যেভাবেই করা হউক না কেন, অত্র ধারার অর্থানুসারে তা উক্তি বা বিবৃতি বলে বিবেচিত।
ব্যাখ্যা ২: সত্যতা নিরূপণকারী লোকের বিশ্বাস সংক্রান্ত মিথ্যা উক্তি অত্র ধারার অর্থে অন্তর্ভুক্ত। কোন লোক যা বিশ্বাস করে না, তা সে বিশ্বাস করে বলে এবং যা সে জানে বলে উক্তি করলে সেই লোক মিথ্যা সাক্ষ্য দানের জন্য অপরাধী হবে।
বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থাদিতে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান বা জেনে শুনে সত্য গোপন করার বিরুদ্ধে সাবধান বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। তথাপি আমাদের আইন অঙ্গনে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান এবং মিথ্যা সাক্ষ্য ব্যবহারের নজির বিরল নয়। মিথ্যা সাক্ষ্য একটি মামলাকে ঠিক বিচারের আওতার বাইরে নিয়ে যায়। এটা দেওয়ানি এবং ফৌজদারি উভয় মামলার ক্ষেত্রেই দেখা যায়। ফলে, মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের অপরাধকে হালকাভাবে দেখা উচিত নয়। মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানকারী ব্যক্তির প্রতি আদালতের কোন দয়া দেখানো উচিত নয় ।
অনেকে মনে করে থাকেন, মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের অভিযোগে কেবল রায় প্রদানের পরই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। আসলে বিষয়টি এমন নয়। মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান একটি পৃথক (distinct) offence। যখনই আদালত মিথ্যা সাক্ষ্য বিষয়ে নিশ্চিত হবেন, তখনই তিনি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৫(১)(বি) ধারা অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলায়ই দেখা যায় সাক্ষী ঠিক বক্তব্যটি দিচ্ছে না।
আবার অনেক সময় দেখা যায় সাক্ষী পূর্বের বক্তব্যের স্বার্থে সাংঘর্ষিক সাক্ষ্য প্রদান করছে। কিংবা হলফনামার মাধ্যমে কোনো পক্ষ মিথ্যা বর্ণনা দিচ্ছে । এ সকল বিষয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের অপরাধ কতটা জড়িত তা বুঝার আগে আমাদের জানতে হবে দণ্ডবিধির অধীনে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান বলতে আসলে কী বুঝায়?
বিষয়টি দণ্ডবিধির ১৯১ ধারায় সংজ্ঞায়িত আছে। দণ্ডবিধির ১৯৩, ১৯৪, ১৯৫, ১৯৬ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান এবং মিথ্যা সাক্ষ্য ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান করা হয়েছে। আদালতে সাক্ষ্য প্রদানের পূর্বে সাক্ষীকে শপথ নিতে হয়। শপথ আইনের (The Oaths Act, 1873) এর ১৪ ধারা অনুসারে সাক্ষী সত্য বর্ণনা দিতে বাধ্য। এই ধারার ভাষাটি খুব দৃঢ়। অর্থাৎ শপথ নেওয়ার পর সত্য বলতে আইনই সাক্ষীকে বাধ্য করেছে।
দণ্ডবিধির ১৯১ ধারায় বর্ণিত “Whoever being legally bound by an oath” এবং শপথ আইনের ১৪ ধারাই মূলত একজন সাক্ষীকে সত্য সাক্ষ্য দেওয়ার বাধ্যবাধকতায় ফেলে। ফলে আইনের এমন বাধ্যবাধতকার ব্যত্যয় ঘটালে তা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে হবে। এই শাস্তির বিধান করা হয়েছে দণ্ডবিধির ১৯৩ ধারায়। কোনো সাক্ষ্যকে তখনই মিথ্যা সাক্ষ্য বলা যাবে যখন তা দণ্ডবিধির ১৯১ ধারার শর্তসমূহ পূরণ করবে । কী সেই শর্ত?
প্রথমতঃ কোনো ব্যক্তিকে আইনত শপথ নিয়ে বা আইনের কোনো বিধান মোতাবেক সত্য সাক্ষ্য দিতে বাধ্য হবেন;
দ্বিতীয়তঃ কোন বিষয়ে ঘোষণা দেওয়ার জন্য আইন দ্বারা বাধ্য হবেন;
তৃতীয়তঃ উক্ত ব্যক্তি মিথ্যা বক্তব্য প্রদান করবেন; এবং
চতুর্থতঃ মিথ্যা জেনেও বা মিথ্যা হিসেবে বিশ্বাস করেও বা সত্য নয় জেনেও উক্ত বক্তব্য পেশ করবেন।
মামলা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হলে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিতে পারেন। এমন কি আদালত মিথ্যা অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে দণ্ডমূলক ব্যবস্থাও নিতে পারেন। আমলযোগ্য নয় এরকম কোনো মামলায় কোনো পুলিশ কর্মকর্তা মিথ্যা প্রতিবেদন দিলে তাঁর বিরুদ্ধেও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ দিতে পারেন।
দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলার সাজা হলো— দুই বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম ও বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় ধরনের দণ্ড। যদি মিথ্যা মামলা কোনো মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা সাত বছর বা তার বেশি মেয়াদের কোনো দণ্ডনীয় অপরাধ সম্পর্কে দায়ের করা হয়, তাহলে মিথ্যা মামলা দায়েরকারী বা বাদী সাত বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়দের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। এর সঙ্গে মিথ্যা মামলা দায়েরকারীকে অর্থদন্ডে দন্ডিত করা যাবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ১৭ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের অভিপ্রায়ে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অন্য কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নাই জেনেও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন বা করান, তা হলে মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তি এবং যিনি অভিযোগ দায়ের করিয়েছেন উক্ত ব্যক্তি অনধিক সাত বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।’
এই প্রসঙ্গে উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলার সিদ্ধান্তসমূহ নিম্নে আলোকপাত করা হল-
10 DLR (W.P) 5 Aqil Hossaik Shah Vs. Pakistan State মামলার সিদ্ধান্তে দেখা যায় -False evidence given intentionally-It must be proved that false evidence was given intentionally. Conviction cannot be sustained without a clear finding as to that.
42 DLR (1990) (HCD) 201 Mohd. Raushan Ali Vs. Bangladesh Bar Council: মামলার সিদ্ধান্তে দেখা যায়“The tribunal shall have the same powers as vested in Civil Court for the purpose of inquiry and every inquiry as such shall be deemed to be judicial proceeding within the meanings section of 193 and 228 P.C.- A tribunal shall be deemed to be a Civil Court for the purposes of section 480 and 482 CrPC. The proceeding before a tribunal is of a Civil nature and as such there appears to be no bar to effect a compromise between the parties in a proceeding before the tribunal.”
17 BLD (1997) (HCD) 547 A Hamid Advocate Vs. Bangladesh Bar Council: মামলার সিদ্ধান্তে দেখা যায়“The Court issued a suo motu Rule under section 476 CrPC upon delinquent Abdul Majid to show cause as to why an inquiry should not be made as to whether he gave false evidence as PW-2 on 19-4-92 before Bar Council Tribunal No. 11 in a complaint case and thereby committed an offence punishable under section 193 of the Penal Code”.
50 DLR (1998) (HCD) 629 Idris Miah Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে দেখা যায়– “If a court fins that any witness committed an offence undersection 193, the court is to proceed in accordance with the provisions of section 476 of the Code of Criminal Procedure because the offence under section 193 is included in section195 (1) (b) of the Code. A tribunal constituted under section 26of the Special Powers Act is also required to follow the provisions of section 476 of the Code of Criminal Procedure if it likes to proceed against any witness of a case for commission of offence under section 193 of the Penal Code”.
42 DLR 201 Md. Rawsan Ali Vs. Bangladesh Bar Council মামলার সিদ্ধান্তে দেখা যায়, “সামরিক আদালতে কোন লোক মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে তাও অত্র ধারার আওতায় দণ্ডনীয়।ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক তদন্ত এবং অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে দেওয়ানী আদালতের উপর ন্যস্তক্ষমতার অনুরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। তদুপরি ট্রাইব্যুনালকে দণ্ডবিধির ২২৮ধারা এবং ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৮০ এবং ৪৮১ ধারায় প্রায় সমানে প্রয়োগ করতে পারবে”।
5 B.L.C. 286 Masudur Rahaman Vs. The State মামলার সিদ্ধান্তে দেখা যায়, “It should be born in mind that any allegations of offence alleged to have been committed in or in relation of any proceedings in any court, should not be taken lightly. There is no scope for showing leniency or complacency in this regard. Rather, it is imperative on the part of the concerned court to deal promptly with such allegations and strictly in accordance with law, as it concerns the administration of public justice.”
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার শাস্তি
যদি কেউ আদালতে শপথ করার পরেও মিথ্যা সাক্ষ্য দেন তবে তিনি শাস্তি পেতে পারেন। দণ্ডবিধির ১৯৩ ধারা অনুসারে বিচারিক প্রক্রিয়ার কোনো পর্যায়ে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে বা সাক্ষ্য বিকৃত করলে, ওই ব্যক্তি সাত বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে বা সাক্ষ্য বিকৃত করলে মিথ্যা সাক্ষ্য দানকারী তিন বছরের কারদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
দণ্ডবিধির ১৯৪ ধারা অনুসারে কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে বা সাক্ষ্য বিকৃত করে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য কোনো অপরাধে কাউকে দণ্ডিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখলে, সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন বা ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। মিথ্যা সাক্ষ্য বা সাক্ষ্য বিকৃত করার ফলে যদি কোনো নির্দোষ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়, তাহলে মিথ্যা সাক্ষ্য দানকারীকে আদালত মৃতুদণ্ড এবং ইতিপূর্বে বর্ণিত অন্যান্য দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারেন।
সুতরাং বলা যায় যে, যদি কোন লোক কোন শপথক্রমে বা আইনে কোন প্রকাশ্য বিধান অনুসারে সত্য বলতে আইনতঃ বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও, অথবা কোন বিষয়ে একটি ঘোষণা প্রদান করতে আইনানুসারে বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও, এমন কোন উক্তি করে বা বিবৃতি দান করে যা মিথ্যা, এবং যা হয় সে মিথ্যা বলে জানে, না হয় সে মিথ্যা বলিয়া বিশ্বাস করে অথবা যা সে সত্য বলে বিশ্বাস করে না, তবে উক্ত লোক মিথ্যা সাক্ষ্য দান করে বলে গণ্য হয়।
তথ্য কণিকা: ফৌজদারী কার্যবিধি- জহিরুল হক, ফৌজদারী কার্যবিধি- মুহাম্মদ সাইফুল আলম, ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্য-গাজী শামসুর রহমান, ফৌজদারী মামলার বিচার এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়- কে. এম. রাশেদুজ্জামান রাজা, দণ্ডবিধির ভাষ্য- গাজী মোঃ শামসুর রহমান, উকিপিডিয়া, দণ্ডবিধি- মোঃ আবুল কালাম আজাদ, দণ্ডবিধি- বাসুদেব গাংগুলী, শতাধিক বছরের ক্রিমিনাল কেস রেফারেন্স- এডভোকেট কামাল উদ্দিন, ক্রিমিনাল কেস রেফারেন্স- জীবরুল হাসান, Section Wise 100 years Reference on Crpc, Section Wise 100 years Reference on Penal Code- Md. Abul Kalam Azad.