ফাইজুল ইসলাম : সম্প্রতি বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার কমিশন সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করার প্রস্তাব করেছে। তাদের প্রতিবেদনে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাবনা রয়েছে, যেখানে নিম্নকক্ষ জাতীয় সংসদ এবং উচ্চকক্ষ সিনেট থাকবে, উভয়ের মেয়াদ হবে চার বছর।
এই প্রস্তাবনার পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি রয়েছে। পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয় চার বছরের মেয়াদ জনগণের মতামত দ্রুত প্রতিফলিত করবে এবং রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা বাড়াবে। বিপক্ষে যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়, দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অসুবিধা হতে পারে এবং ঘন ঘন নির্বাচন রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াতে পারে।
সংসদের মেয়াদ চার বছর করা উচিত কিনা তা নির্ভর করবে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের ওপর। এ বিষয়ে আরও গবেষণা ও পর্যালোচনা প্রয়োজন। বাংলাদেশে সংসদের মেয়াদ ৫ বছর থেকে কমিয়ে ৪ বছর করলে কিছু উল্লেখযোগ্য সুবিধা থাকতে পারে।
ধরুন, একটি সরকার ক্ষমতায় এসে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। যদি মেয়াদ ৫ বছর হয়, তাহলে এই ব্যর্থ সরকার ৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকবে। তবে মেয়াদ ৪ বছর হলে জনগণ দ্রুত নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের সুযোগ পাবে। জনগণ সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে দ্রুত সেবা পেতে পারবে, যা গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে।
অস্ট্রেলিয়ার সংসদীয় মেয়াদ ৩ বছর। এই কম সময়ের মধ্যে, সরকার জনগণের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দ্রুত কাজ করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে সংসদের মেয়াদ ৪ বছর হলে, সংসদ সদস্যরা জানবেন যে তাদের সময় সীমিত। ফলে তারা দ্রুত এবং কার্যকরভাবে কাজ করতে মনোযোগী হবেন।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেসের মেয়াদ ৪ বছর। এটি নিয়মিত নতুন নেতৃত্বের সুযোগ সৃষ্টি করে। ৪ বছরের মেয়াদে নির্বাচনের সম্ভাবনা বাড়ায়, যার মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব উঠে আসার সুযোগ পাবে। তরুণ এবং উদ্যমী নেতারা রাজনীতিতে আসতে আরও বেশি উৎসাহিত হবেন।
বারাক ওবামা তার প্রথম মেয়াদে অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার জন্য কাজ করেন এবং স্বাস্থ্যসেবা সংস্কারের মতো উদ্যোগ নেন। বারাক ওবামা প্রথম ৪ বছরে তার কাজের মূল্যায়ন করে জনগণ তাকে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত করে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ৪ বছরের মেয়াদে অভিবাসন নীতি এবং কর হ্রাসের মতো বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেন। তবে জনগণ তার নীতিমালার মূল্যায়ন করে ২০২০ সালের নির্বাচনে তাকে পুনর্নির্বাচিত করেনি।
নিউজিল্যান্ডে ঘন ঘন নির্বাচন হওয়ার ফলে রাজনীতিকদের জনগণের ইচ্ছা ও চাহিদার বিষয়ে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে জেসিন্ডা আরডার্ন প্রথমবার ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার সরকার কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় দক্ষতা দেখানোর কারণে ২০২০ সালের নির্বাচনে পুনঃনির্বাচিত হয়। ঘন ঘন নির্বাচনের ফলে জনগণ তার কাজের দ্রুত মূল্যায়ন করতে পেরেছে।
একটা উত্তম উদাহরণ হল স্কট মরিসন সরকারের অধীনে বিগত করোনাকালীন সময়ে অস্ট্রেলিয়া ব্যাপক টিকাদান কর্মসূচি চালু করে। ৪ বছরের মধ্যে এই কর্মসূচি সফলভাবে পরিচালিত হলে সরকার এবং জনগণ উভয়েই তার ফলাফল দেখতে পায়। সরকার প্রাথমিকভাবে ২০২১ সালের মার্চ মাসে টিকা প্রদান শুরু করে এবং ২০২২ সালের মধ্যে এক বড় অংশ জনগণের টিকা নেওয়া সম্পন্ন হয়।
ফলাফল হিসেবে ২০২২ সালের নির্বাচনে জনগণ টিকাদান কর্মসূচি এবং কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকারের পদক্ষেপ মূল্যায়ন করে। তবুও কিছু সমালোচনাও ছিল, বিশেষত টিকা সরবরাহ এবং পরিবহন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে। দ্রুত নির্বাচন হলে স্বৈরাচার হওয়ার পথটা থাকে না।
ভারতের রাজ্য বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনের মেয়াদ সাধারণত ৫ বছর। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্বাচনী মেয়াদ ছোট হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে দিল্লি বিধানসভার কার্যক্রম উল্লেখ করা যায়।
দিল্লি বিধানসভার বর্তমান সরকার অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে ২০১৫ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করে প্রশংসা অর্জন করে। কেজরিওয়াল সরকার দিল্লির ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের জন্য বিনামূল্যে পরিষেবা চালু করে। এর ফলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবার সরাসরি উপকৃত হয় এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
রাজ্য সরকার মোহল্লা ক্লিনিক চালু করে যা প্রত্যেকের জন্য সহজলভ্য করে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দেয়। এই উদ্যোগ স্বাস্থ্য খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত সরকারি স্কুলগুলোতে অবকাঠামো উন্নয়ন, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ চালু করা হয়। এর ফলে দিল্লির শিক্ষার মান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে।
বাংলাদেশে ৪ বছরের মেয়াদ হলে, রাজনীতিবিদরা জানবেন যে জনগণের মন কি চায়,তাদের উন্নয়নের জন্য কি কি দলীয় সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন, সেই সাথে দক্ষ ও যোগ্য সাংসদ নির্বাচিত হবে। নির্বাচনের একটা প্রভাব হল নির্বাচন দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে দীর্ঘমেয়াদি। সাধারণ নির্বাচন শেয়ার বাজারে প্রভাব ফেলে। তাদের ফলাফলের অনিশ্চয়তা সাধারণত ভোট দেওয়ার আগে বাজারের অস্থিরতা বাড়ায়।
সদ্য প্রতিষ্ঠিত সরকারের নীতিগত অগ্রাধিকারগুলি স্পষ্ট হওয়ার কারণে একটি নির্বাচন হওয়ার পরে বাজারগুলিও সামঞ্জস্য করতে থাকে।বিজয়ের একটি সুস্পষ্ট ব্যবধান এবং একটি প্রত্যাবর্তনকারী দায়িত্ব অনিশ্চয়তা কমাতে এবং শেয়ার বাজারে পরিলক্ষিত অস্থিরতা হ্রাস করার প্রবণতা।
দ্রুত ৪ বছর পর পর নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ সরকারের কাজ এবং প্রকল্পগুলো মূল্যায়ন করবে, যার ফলাফল হিসেবে সরকার জনমুখী সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত হবে। নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়িত হবে যাতে জনগণ তাদের সিদ্ধান্তের মূল্যায়ন করতে পারে।
ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর সরকারের বিভিন্ন বড় প্রকল্প যেমন “মেক ইন ইন্ডিয়া”, “স্বচ্ছ ভারত” এবং “ডিজিটাল ইন্ডিয়া” শুরু করে। ৪ বছরের মধ্যে এই প্রকল্পগুলোতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হয় যা ভারতে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ডিজিটাল সেবা প্রসারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসে। এভাবে ৪ বছরের মেয়াদ সরকারের কার্যক্রমকে আরও দ্রুত এবং কার্যকরী করে তুলতে পারে যা বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য সহায়ক হবে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে যে দ্রুত নির্বাচন একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। দীর্ঘ সময় পর পর নির্বাচন হওয়া রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে যা সরকারের কাজের গতি এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে।অধ্যাপক বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন এর মতে দ্রুত নির্বাচন একটি দেশকে “সামাজিক চুক্তি”র আওতায় দ্রুততা ও উন্নতি নিয়ে আসে।” কম সময়ের নির্বাচনী মেয়াদ সরকারকে তাড়িত করে এবং জনগণকে নতুন সম্ভাবনার সন্ধানে সরকারকে ভাল কাজের করতে বাধ্য করে।
লেখক: ফাইজুল ইসলাম; প্রভাষক, আইন বিভাগ, প্রাইম ইউনিভার্সিটি।