অপরাধীরও আইনানুগভাবে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে
মো. আরিফুর রহমান

অপরাধীরও আইনানুগভাবে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে

মো. আরিফুর রহমান : কোনো ফৌজদারি অপরাধ সংগঠিত হলেই দেখা যায় অপরাধীকে মারতে সবাই ঝাপিয়ে পড়েন, অথচ কারো গায়ে হাত তোলার আগে যাচাই করে নেওয়া উচিত, সে আসলেই অপরাধী কি-না বা অপরাধ সংঘটিত করেছে কি-না। আমাদের দেশে আইন হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি, আইন তা সমর্থন করে না।

আপনি যখন কারো গায়ে হাত তুলছেন, আপনাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে একটি অপরাধ দমন করতে গিয়ে আরেকটি অপরাধ করছেন কি-না। অভিযুক্ত-কে সাক্ষ্য-সাবুধ গ্রহণের পর একমাত্র শাস্তি বা দণ্ড দিতে পারেন মাননীয় আদালত; অন্য কারো এ অধিকার বা সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে আপনার প্রশ্ন থাকতেই পারে সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার বা আমাদের করণীয় কি?

আপনি বা আপনারা ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ৫৯ ধারা ব্যবহার করতে পারবেন- তথায় উল্লেখ রয়েছে-

সাধারণ ব্যক্তি কর্তৃক গ্রেফতার এরূপ গ্রেফতারের পরবর্তী কার্যপদ্ধতি -(ব্যাখ্যা) যে কোন বেসরকারি ব্যক্তি, তার মতে জামিন অযোগ্য ও আমলযোগ্য অপরাধী ব্যক্তিকে, অথবা অপরাধী মর্মে ঘোষিত কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারেন এবং অযথা বিলম্ব না করে তাকে পুলিশ অফিসারের নিকট অর্পণ করবেন অথবা পুলিশ অফিসারের অনুপস্থিতিতে তাকে নিকটস্থ থানার হেফাজতে নিয়ে যাবেন অথবা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন।

তখন পুলিশ প্রয়োজন অনুযায়ী ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ৫৪ ও ৫৭ ধারার ব্যবহার করবেন।

আরও পড়ুন : এমসি কলেজে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ : বিচার তিন বছর আটকে থাকায় প্রধান বিচারপতির ক্ষোভ

ধরুন, আপনার সামনে একটি মানুষ খুন হয়েছে। স্বাভাবিক দৃষ্টিকোন থেকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আপনি খুন-খুন বলে চিৎকার করবেন এবং যিনি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছেন তাকে খুনি বলে আখ্যায়িত করবেন; অথচ আইন অনুযায়ী প্রমাণিত না-হওয়া পর্যন্ত কাউকে খুনি বলা যাবে-না।

আপনার দৃষ্টিতে যা- খুন আইনের দৃষ্টিতে তা- খুন না- হয়ে নরহত্যা হতে পারে কিংবা আত্মরক্ষায় ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগও হতে পারে। ফলে আসামি এখানে নির্দোষ ও হতে পারেন। মনে রাখা উচিত সকল খুনই অপরাধজনক নরহত্যা; কিন্তু সকল অপরাধজনক নরহত্যা খুন নয়।

চলমান সময়ে ধর্ষণ একটি আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে- একজন আইনজীবী হিসেবে আমার অবস্থান প্রথমে পরিষ্কার করছি, আমি মনে করি আলোচিত এবং প্রমাণিত ধর্ষণের ক্ষেত্রে আইনজীবী হিসেবে, প্রকৃত ধর্ষকের পক্ষে আইনি সেবা দেওয়া উচিত নয়, যা- আদর্শ ও নৈতিকতা পরিপন্থী।

কিন্তু এর বিকল্প চিত্র ও রয়েছে “প্রেম করেছ তুমি, মন দিয়েছি আমি এখন সব দোষ আমার!” এবার ব্যাখ্যায় যাওয়া যাক- দু’জনের ইচ্ছায় প্রেম হয়, আবার দু’জনের ইচ্ছায় হয় শারীরিক সম্পর্ক। দু’জনের সম্পর্ক যখন মাখামাখি অবস্থা বিরাজমান ঠিক তখনই তৃতীয় পক্ষের অবস্থান কিংবা অন্য কোনো কারণে যখন সম্পর্কে অবনতি হয়, ভাঙ্গন ধরে সম্পর্কে, তখন ছেলেটার কোনোরকম দোষ না- থাকা সত্বেও তাকে বিয়ে করতে চাপ প্রয়োগ করা হয়, যখনই সে বিয়ে করতে আপত্তি জ্ঞাপন করে এবং সে বুঝতে পারে তার সাথে জীবনের অবশিষ্ট সময় পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয়, তখন সেই নারী কর্তৃক শুরু হয় মিথ্যা অপবাদ দেওয়া, একপর্যায়ে পরিনতি মিথ্যা মামলায় গিয়ে গড়ায়।

আরও পড়ুন : সাত বছরের শিশু ধর্ষণের দায়ে গৃহশিক্ষকের মৃত্যুদণ্ড

প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণ না – করেও তাকে মিথ্যা ধর্ষণের মামলায় হতে হয় আসামি। এছাড়াও দেখা যায় নানা ঘটনা প্রবাহ রয়েছে, তখন রুজকৃত মিথ্যা মামলা থেকে অভিযুক্তকে আইনি সহায়তা বা রক্ষাকরা আইনজীবী হিসেবে পেশাগত দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। মিথ্যা মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে তারা যেমন-দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৪৯৩, ৪৯৫, ৪৯৬, ৪৯৭, ৩৫৪, ৫০৯ ধারা তৎসহ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ধারা-৯, ৯ক, ১০, ১১ এবং যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ এর ৩, ৪ ধারা-সহ ইত্যাদি এর বহুল ব্যাবহার দেখা যায়।

এক্ষেত্রে একদিকে যেমন সত্য বিরাজমান, অপরদিকে মিথ্যার রমরমা ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। অপরাধ না করেও অনেক পুরুষ অপরাধী হতে হয়। একজন পুরুষ বিয়ের আগে ও পরে কতো প্রকারের মিথ্যা মামলার শিকার হন আদালত পাড়ায় নিয়মিত না আসলে; খালি চোখে অনুধাবন সম্ভব নয়। আইনের দৃষ্টিতে একজন অভিযুক্ত বা অপরাধীরও আইনানুগভাবে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

উদ্ভূত প্রেক্ষাপটে কোনো অভিযুক্ত মানুষ যেনো স্বীকৃত আইনি সেবা এবং ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হয়, তার পক্ষে আইনি সেবা দেওয়ারও রয়েছে আইনগত ভিত্তি। ফলে কারো আইনি অধিকার কোনোভাবেই খর্ব করার সুযোগ নেই।

মনে রাখা জরুরি, মিথ্যা মামলা করলে দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ২১১ ধারায় যেমন শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়, ঠিক তেমনি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ১৭ ধারার বিধান অনুযায়ী- যিনি মিথ্যা মামলা বা অভিযোগ দায়ের করবেন,তা- প্রমাণ হলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৭ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।

লেখক: আইনের শিক্ষক ও আইনজীবী, জজ কোর্ট, সিলেট।