মাসুদুর রহমান : বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণ একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এর বিচার দ্রুত শেষ করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবে ৩০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার বিচার শেষ করা অত্যন্ত কঠিন। মাগুরায় আট বছরের শিশু আছিয়া হত্যা ও ধর্ষণের মামলার বিচার ৩০ দিনে শেষ করা সম্ভব কিনা?
আইনি কাঠামো ও সময়সীমা
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০২০)-এর ২০(৩) ধারায় বলা হয়েছে যে, ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের অন্যান্য মামলার বিচার কার্যক্রম ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। তবে বাস্তবে বেশিরভাগ মামলাই নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শেষ করা সম্ভব হয় না।
বাস্তবতা: কেন ৩০ দিনের মধ্যে বিচার সম্ভব হয় না?
১. তদন্ত সংক্রান্ত জটিলতা
• ধর্ষণের মামলায় ফরেনসিক রিপোর্ট, ডিএনএ টেস্ট, মেডিকেল রিপোর্ট, এবং অন্যান্য আলামত সংগ্রহ করা হয়, যা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ।
• পুলিশ তদন্ত সম্পন্ন করে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) আদালতে দাখিল করতে ৩-৬ মাস বা তারও বেশি সময় নিতে পারে।
২. মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া
একটি ধর্ষণ মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া বেশ কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়:
- এফআইআর দায়ের
- তদন্ত ও আলামত সংগ্রহ
- চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল
- আদালতে শুনানি ও সাক্ষ্যগ্রহণ
- উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন
- রায় ঘোষণা
এই প্রতিটি ধাপ সম্পন্ন করতে সাধারণত ৬ মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।
৩. সাক্ষীর অনুপস্থিতি ও বিলম্বিত শুনানি
• অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী বা সাক্ষীরা আদালতে হাজির হতে ভয় পান বা সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপে মামলা চালিয়ে যেতে পারেন না।
• সাক্ষীদের নিরাপত্তার অভাব এবং হুমকির কারণে তারা আদালতে ঠিকমতো সাক্ষ্য দেন না বা বারবার শুনানি পিছিয়ে যায়।
৪. আদালতের মামলা জট
• বাংলাদেশে মামলা নিষ্পত্তির হার তুলনামূলকভাবে কম এবং বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বেশি হওয়ায় আদালতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়।
• নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল থাকলেও মামলার চাপ এত বেশি যে দ্রুত রায় দেওয়া সম্ভব হয় না।
৫. রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপ
• অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রভাবশালী হলে মামলাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়।
• ভুক্তভোগী ও তার পরিবার সমাজ বা স্থানীয় প্রশাসনের চাপে মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন, যা বিচার প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করে।
উদাহরণ: বাংলাদেশে দ্রুততম ধর্ষণ মামলার বিচার
বাংলাদেশে কিছু ক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে ধর্ষণ মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। যেমন: রূপা ধর্ষণ ও হত্যা মামলা: মাত্র ২৩ কার্যদিবসে রায় ঘোষণা করা হয়। এই মামলা ছিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিচালিত বিশেষ মামলা, যেখানে পুলিশ দ্রুত চার্জশিট দাখিল করেছে, সাক্ষীরা সময়মতো হাজির হয়েছেন এবং আদালত মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করেছে।
৩০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার বিচার কীভাবে সম্ভব হতে পারে?
১. তদন্ত দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে
• ফরেনসিক ও মেডিকেল রিপোর্ট দ্রুত দিতে হবে।
• পুলিশকে তদন্ত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করার জন্য কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে।
২. ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে
• নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
৩. ডিজিটাল সাক্ষ্যগ্রহণ ও শুনানি চালু করতে হবে
• সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণ করলে বিচার দ্রুত শেষ করা সম্ভব।
৪. আইনি সহায়তা সহজলভ্য করতে হবে:
• ভুক্তভোগী ও তার পরিবারকে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা প্রদান করতে হবে।
৫. সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে
• সাক্ষীদের হুমকি দেওয়া হলে দ্রুত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
চূড়ান্ত মন্তব্য
বাংলাদেশে ধর্ষণ মামলার বিচার ৩০ দিনের মধ্যে শেষ করা আইনগতভাবে সম্ভব হলেও বাস্তবে এটি বেশ কঠিন। তবে যদি সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালত সমন্বিতভাবে কাজ করে, তাহলে বিচার দ্রুততর করা সম্ভব। ট্রাইব্যুনালে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলা পরিচালনা করলে কিছু ক্ষেত্রে ৩০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করা সম্ভব হতে পারে, তবে এটি এখনো ব্যতিক্রমী ঘটনা। উল্লেখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে মাগুরায় আট বছরের শিশু আছিয়া হত্যা ও ধর্ষণের মামলার বিচার ৩০ দিনে শেষ করা সম্ভব।
লেখক : মাসুদুর রহমান; আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।