চেকের মামলা দেওয়ানী মোকদ্দমার মতো সংশোধনী ও প্রাসঙ্গিক আইন
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

চেকের মামলায় আসামীর মুক্তির উপায়সমূহ ও বাস্তবতা!

সিরাজ প্রামাণিক : বর্তমানে চেক সংক্রান্ত জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্বভাবতই চেকের মামলার সংখ্যাও বেড়েছে। চেকের মামলার বেশীরভাগই নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট এ্যাক্ট-এর ১৩৮ ধারা মতে হয়ে থাকে। চেক লেনদেন নিয়ে রয়েছে নানা জটিলতা। একটি চেক অনেকসময় হাতবদল হয়ে চলে যায় ভিন্ন ভিন্ন মানুষের হাতে। গোল বাধে তখনই, যখন চেকটা ডিজঅনার হয়। কার দেয়া চেক কার কাছে ডিজঅনার হলো। চেক ইস্যুকারীকে হয়ত তিনি চেনেনই না। নাম-ধামও জানেন না। তাহলে মামলা করবেন কার বিরুদ্ধে? এমনও দেখা গেছে, যার বিরুদ্ধে তিনি মামলা করেছেন, চেকটা তার নয়। কাজেই মামলা খারিজ।

এতো গেলো কিছু ব্যতিক্রমী বিষয়। এবার আসি ১৩৮ ধারা মামলার কিছু অসঙ্গতি ও আসামীর খালাস প্রাপ্তির কারণসমূহ।

একটি কেস স্টাডিতে জানা যায়, আসামী ব্যবসায়িক কারণে বাদীর নিকট থেকে নয় লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা ধার গ্রহণ করেন। এরপর টাকা পরিশোধে চেক দেন। সেই চেকটি ব্যাংক থেকে ডিসঅনার হয়। বাদী আদালতে মামলা করে দিলেন। সেই মামলায় আসামী পক্ষে ডিফেন্স নিতে গিয়ে দেখা গেল যে, দিন, ক্ষণ, তারিখ, সময়, টাকা লেনদেনের স্থান, সাক্ষীদের উপস্থিতি এসব কোন কথায় বাদির নালিশী আরজিতে উল্লেখ নেই। এমনকি বাদী জবানবন্দিতেও এ কথাগুলো বলেন নাই। এন.আই এ্যাক্ট মামলা প্রমাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার নোটিশ প্রাপ্তির বিষয়। আসামীর উপর নোটিশ জারী ১৩৮ ধারার মামলার পূর্ব শর্ত, ব্যর্থতায় আসামী খালাস পাবে।

উল্লেখিত মামলায়-

১। আসামী কর্তৃক লিগ্যাল নোটিশ প্রাপ্ত হওয়ার কোন তারিখ উল্লেখ করেননি
২। নোটিশ প্রাপ্তির প্রমাণস্বরুপ প্রাপ্তি স্বীকার মাননীয় আদালতে সাবমিট করতে পারেন নাই
৩। ফেরত খামও আদালতে উপস্থাপন কিংবা নালিশী আরজিতে উল্লেখ করতে পারেন নাই
৪। পোষ্ট মাস্টারের কোনরুপ প্রত্যয়নপত্রও সাবমিট করতে পারেন নাই।

এ বিষয়ে উচ্চতর আদালতের একটি সিদ্ধান্ত রয়েছে ৩৯ বিএলডি পেজ নং-২২২। সেখানে বলা হচ্ছে, আসামীর উপর নোটিশ জারীর বিষয়ে কোন সন্দেহ সৃষ্টি হলে এবং যদি লক্ষ্য করা যায় যে, আসামী ইচ্ছাকৃতভাবে নোটিশ উপেক্ষা করে নাই, তাহলে ১৩৮ ধারার পূর্বশর্ত পরিপালনে ব্যর্থতার কারণে আসামী খালাস পাবে। কারণ ১৩৮ ধারার (১) উপধারার প্রোভাইশো (বি) তে বলা হয়েছে, আসামী কর্তৃক নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ থেকে ৩০ দিন সময় দিতে হবে। যদি আসামী নোটিশ প্রাপ্ত না হয়, সেই প্রাপ্তির তারিখ জানার সুযোগ আছে কি-না? এই ৩০ দিনের সময় না দিয়ে যদি মামলা দায়ের করা হয় তাহলে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদের মৌলিক অধিকার পরিপন্থী।

এন.আই এ্যাক্টের তামাদি বিষয়

তামাদির মেয়াদ এ আইনের ১৪১ (বি) ধারায় ধার্য্য করা হয়েছে। ফৌজদারী কার্যবিধির ২২১ ধারার ৫ উপধারায় বলা হয়েছে যে, অভিযোগ গঠনের সময় অপরাধ সংগঠনের আইনানুগ সকল উপাদান অভিযোগে থাকতে হবে। যদি নালিশী দরখাস্তে আসামী কর্তৃক নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ উল্লেখ না থাকে, সেই তারিখ থেকে ৩০ দিন সময় না দেয়া হয়, সেই ৩০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে মামলা করা না হয়, তাহলে ১৩৮ ধারার চেক ডিসঅনারের অপরাধ সংগঠনের ০৩টি উপাদানের অনুপস্থিত থাকবে বলে তা অপরাধ সংগঠনে ব্যর্থ হবে।

অনেক সময় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জেনারেল ক্লজেস এ্যাক্ট এর ২৭ ধারার বিধান তুলে ধরে কিছু ‘লেইম এক্রকিউজ’ উপস্থাপন করা হয়। চেক ডিসঅনারের অপরাধের ক্ষেত্রে জেনারেল ক্লজেস এ্যাক্ট এর ২৭ ধারার বিধান প্রয়োজ্য হবে কি-না? দ্যা জেনারেল ক্লজেস এ্যাক্ট প্রনীত হয়েছে ১৮৯৭ সালে আর দ্যা নেগোসিয়েবল ইনষ্ট্রমেন্ট এ্যাক্ট প্রনীত হয়েছে ১৮৮১ সালে। ১৬ বছর আগে জন্ম হয়েছে এন.আই. এ্যাক্টের। আর দ্যা জেনারেল ক্লজেস এ্যাক্ট এর ২৭ ধারা বলছে যে, এই ধারার বিধানাবলী কার্যকরী হবে দ্যা জেনারেল ক্লজেস এ্যাক্ট চালু হওয়ার পর থেকে। এ বিষয়ে ৬৪ ডিএলআর ২৫৫ পৃষ্ঠায় উচ্চ আদালতের একটি দারুন সিদ্ধান্ত রয়েছে।

নোটিশ জারির বিষয় অনুমান

নোটিশ জারির বিষয় অনুমান প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে ডাক পিওনকে পরীক্ষা করার বিষয়ে বলা আছে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ৭ এসসিসি ৫১০ পৃষ্ঠায় বলছেন, বাদী ডাক পিওনকে আদালতে পরীক্ষা করে নোটিশ জারির বিষয় ২৭ ধারার অধীন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নোটিশ জারি হয়েছে প্রমাণের দায়িত্ব কার? নোটিশ যে জারি হয়েছে তা প্রমাণের দায়িত্ব একমাত্র বাদীর। এ বিষয়ে ৬০ ডিএলআর ৬৭৭ পৃষ্ঠায় উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে।

ব্ল্যাংক চেকের ক্ষেত্রে

চেকটি অনেক সময় ব্ল্যাংক চেক হয়ে থাকে। ঋণ প্রদানের আগেই কিছু ব্ল্যাংক চেক নেয়া হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বোম্বে হাইকোর্ট ২০১০ সালের ডিসিআর ২ নং ভলিউমের ৩১৭ পৃষ্ঠায় একটি দারুন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। হাইকোর্ট বলছেন, ঋণ প্রদানের আগে জামানত স্বরুপ হিসেবে ব্ল্যাংক চেক গ্রহণ করা হলে তা কোন দায় দেনার অস্তিত্ব সৃষ্টি করে না বিধায় তার দ্বারা চেক ডিসঅনারের মামলা দায়ের করা যায় না। আবার জালিয়াতির মাধ্যমে অর্জিত চেক দিয়ে পক্ষদের মধ্যে কোন দায়দেনার অধিকার সৃষ্টি করে না বলে উচ্চ আদালাতের সিদ্ধান্ত রয়েছে। (এআইআর ১৯৭৫ অল ১০৪)।

চেকের উপর ওভাররাইটিং থাকলে

আবার চেকের উপর ওভাররাইটিং থাকলে কিংবা টেম্পারিং করে তর্কিত চেকের টাকার অংক পরিবর্তন করলেও আসামী খালাস পাবে। এক্ষেত্রে ভারতের পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা হাইকোর্ট ২০১০ সালে ডিসিআর ১ নং ভলিউমের ১০৮ পৃষ্ঠায় একটি দারুন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।

আবার আসামীর স্বাক্ষর, টাকার অংক এবং পেয়ীর নাম ভিন্ন হাতের লেখা হলে এনআই এ্যাক্টের ৩ (ই) ধারার বিধান অনুসারে এটাকে ইস্যুয়েন্স অব চেক বলা যাবে না। সেই চেক আইনানুগভাবে বৈধ হবে না। এ বিষয়ে ৫৬ ডিএলআর ৬৩৬ পৃষ্ঠায় একটি সিদ্ধান্ত আছে। সাধারণ উপরোক্ত বিষয়গুলো প্রমাণ করতে পারলেই চেক ডিসঅনারের মামলায় আসামীর খালাস পাওয়া সম্ভব।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com