অভিজিৎ বিশ্বাস : রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান অর্গান রয়েছে- আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ।আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এই তিনটি অর্গানকেই যেমন স্বাধীনভাবে কাজ করতে হয় তেমনি এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করা হতে বিরত থাকতে হয়। এই অর্গানগুলোর প্রথম দুটোর স্বাধীনতায় অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার কতোটুকু প্রয়োজন তা না জানলেও এটুকু জানি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার। কেবল দরকার নয় বলা যায় স্বাধীন বিচারবিভাগ প্রতিষ্ঠায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আশীর্বাদস্বরুপ।
নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অবাধ চর্চায় কোনো দলীয় সরকার কখনোই বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করেনা, কেননা তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার,বিরোধী রাজনৈতিক দলকে শৃঙ্খলিত করার হাতিয়ার হলো বিচার বিভাগ।পরোক্ষভাব তারা বিচার বিভাগের ঘাড়ে বন্দুক রেখে অবাধে তাদের ক্ষমতার চর্চা করতে চায়।
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে যে সংবিধান রচিত হয়েছিল তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদের একটি অনুচ্ছেদ হলো অনুচ্ছেদ -২২, যেখানে বলা হয়েছে রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হতে বিচার বিভাগ এর পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবে। পরিতাপের বিষয় হলো সংবিধান যাকে বলা হয় supreme law of the land, সেই সংবিধানে স্পষ্ট বিধান থাকার পরও ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার আগে কোন দলীয় সরকার সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ কার্যকরে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করেনি।অথচ স্বাধীনতার পর বিগত সকল সরকারের নির্বাচনী এজেন্ডা ছিল ক্ষমতায় যেতে পারলে নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগ পৃথক করবে।
সামরিক-বেসামরিক দলীয় সরকার ক্ষমতায় আসে ঠিকই কিন্ত বেমালুম ভুলে যায় বিচার বিভাগ স্বাধীনে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার। কেননা বিচার বিভাগ স্বাধীন হলে দল-মত নির্বিশেষে মানুষ ন্যায় পাবে, হাকিমের হুকুম সরকারের নির্দেশের অনুগামী হবেনা।আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন যে যারাই ক্ষমতা গ্রহন করে তারাই মনে করে জনগন বা সংবিধান নয় তারাই সকল ক্ষমতার উৎস। তারা এবং তাদের অনুগতগোষ্ঠী সকল ক্ষমতার উর্ধ্বে।তাদের কন্ঠে প্রতিফলিত হয় প্রথম সংবিধান হিসেবে স্বীকৃত “ম্যাগনাকার্টা” এর প্রথম বিধি “King can do no wrong”।ফলে সরকারের কার্যের সমালোচক হলে তাদের ই আইনের দোহাই দিয়ে বেঁধে ফেলতে হবে অত:পর নিম্ন আদালতের বিচারকদের নির্দেশনা দিতে হবে এই সকল মামলায় কোন জামিন দেওয়া চলবেনা।বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা থাকলে তো এটা সম্ভব না।
২০০৭ সালের ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিচার বিভাগের জন্য আশির্বাদ ছিল।দেশ স্বাধীনের পর হতে কোনো সরকার সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ কার্যকর করে নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগ পৃথক না করলেও ফখরুদ্দিনের সরকার তার ক্ষমতার শেষ সময়ে নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগ পৃথকিকরণের আইন করে যায়।এই পৃথকিকরণের আগে আইনের কোন ডিগ্রি নাই এমন বিসিএস ক্যাডাররাও ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার এক্সারসাইস করতে পারতো, এটা ভাবা যায়! আইন কি এতই সরল?বিচার কি এতই সহজ যে আইনের ব্যাকগ্রাউন্ড নেই এমন ব্যক্তিদেরও প্রশিক্ষন দিয়েই বিচারকের আসনে বসিয়ে দেওয়া যায়।
ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি এই কাজটি করে না যেতো তবে অদ্যবধি ক্ষমতায় আওয়ামীলীগ-বিএনপি যে ই থাকতো তারা এটি বাস্তবায়ণ করতো না।বাস্তবায়ন করতোনা শব্দদ্বয় দৃড়ভাবে বলার কারন ১৯৯৭ সালে বিখ্যাত “মাসদার হোসেন” মামলার রায়েই বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের নির্দেশ দেওয়া হয় কিন্ত সেই মামলার রায়ের পর আমাদের প্রধান দুই দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপি সরকার গঠন করলেও কেউই বাস্তবায়ন করেনি।
ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেহেতু বিচারবিভাগ পৃথকিকরণের বিধান করে গিয়েছিল ফলে এর পর ক্ষমতায় আসা আওয়ামী সরকারকে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের অধীনেই ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার এক্মসারসাইসের বিধান করতে হয়।ফখরুদ্দিন আহমেদের সরকারই নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়োগের জন্য বিসিএস এর বিচার ক্যাডার অপসারণ করে “বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস “গঠন করে।বর্তমানে নিম্ন আদালতের বিচারক (সহকারী জজ/জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট)নিয়োগ এই কমিশনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে।ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি গঠিত না হতো তাহলে এটা সম্ভব হতোনা।
২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা হতে শিক্ষা নিয়ে আওয়ামীলীগ সরকার সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত করে।বিদ্যমান সংবিধান সমর্থন করুক আর না করুক আরেকটি অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন দেশ শাসন করছে।এই সরকার সংবিধান -বিচারবিভাগ সহ অন্যন্য বিষয় সংস্কার করতে ৬ টি কমিশন গঠন করেছে। ইতোমধ্যেই কমিশনগুলো সংস্কার প্রস্তাব জমা দিয়েছে। সংবিধান ও বিচারবিভাগ সংস্কারে কমিশন যেসব সুপারিশ করেছে সেগুলোর কিছুক্ষেত্রে আমার দ্বিমত থাকলেও সিংহভাগ সুপারিশ আশাবাদী করছে।বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসম্য আনতে ও সংসদীয় একনায়কতন্ত্র হতে বেরিয়ে আসতে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন অত্যন্ত আবশ্যক।
আদালত হলো নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল।আইনাঙ্গনের একজন ক্ষুদ্র মানুষ হিসেবে আমি দৃড়ভাবে বিশ্বাস করি বিচার বিভাগ সংস্কারই সকল সংস্কারের পূর্বশর্ত।বিচার বিভাগকে যদি সত্যিকার অর্থে স্বাধীন না করা যায় তাহলে কোন সংস্কারই পূর্ণতা পাবেনা।তাই অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিৎ একটি স্বাধীন বিচারবিভাগ নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা।ইতোমধ্যে বাংলেদেশের বর্তমান মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ইতোমধ্যে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিতে অন্তর্বতীকালীন সরকারকে পৃথক বিচার সচিবালয় প্রতিষ্ঠাসহ অন্যন্য বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অঙ্গীকার করেছে জুনের আগে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।সরকারকে বলতে চাই কেবল একটি স্বচ্ছ ও অংশ্রগ্রহনমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান আপনাদের দায়িত্ব নয়, বিচার বিভাগকে সত্যিকারভাবে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও নির্বাহী বিভাগের সকল প্রকার হস্তক্ষেপের উর্ধ্বে রেখে সকল মানুষের জন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা আপনাদের দায়িত্ব।বিচার বিভাগে রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুগামী স্রোতধারা আমরা দেখতে চাইনা।
লেখক : আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট