বিরোধ নিষ্পত্তির প্রাণকেন্দ্র কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিস

বিরোধ নিষ্পত্তির প্রাণকেন্দ্র কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিস

মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী : ২০০০ সালে সর্বপ্রথম দেশে যখন আইনগত সহয়তা প্রদান আইনটি সীমিত পরিসরে চালু হয়, তখন শুধুমাত্র অসচ্ছল, সম্বলহীন, গরীব, নির্যাতিতা অসহায় মহিলা, শিশু, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ সহ বিচার প্রাপ্তিতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থীদের সরকারি খরচে আইনিসেবা দেওয়া হতো। বর্তমানে লিগ্যাল এইড অফিস এখন শুধুমাত্র অস্বচ্ছল নাগরিকদের বিনামূল্যে আইনীসেবা দেওয়ার মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নয়, বিভিন্ন ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তি, ন্যায্য অধিকার নিশ্চিতকরণ ও বিচারপ্রার্থীদের ন্যায্য অর্থ আদায়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

এডিআর (অলটারনেটিভ ডিসপুট রেজুলেশন) অর্থাৎ ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ পদ্ধতির মাধ্যমে কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিসে শুধুমাত্র ২০২৪ সালে একবছরে নিয়মিত আদালতে মামলা না করে এক হাজার ১৮৫ টি বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। একইসময়ে এডিআর এর মাধ্যমে এক কোটি এক লক্ষ ৮২ হাজার ২০০ টাকা অর্থ আদায় করা হয়েছে। যা কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের এ যাবৎ কালের সর্বোচ্চ সংখ্যক বিরোধ আবেদন নিষ্পত্তির রেকর্ড। আদায়কৃত অর্থের মধ্যে মোহরানার অর্থ, ক্ষতিপূরণের অর্থ, চিকিৎসা খরচ, জমি জমার অর্থ, বিদেশে নেওয়ার জন্য দেওয়া অর্থ ফেরত নেওয়া, সন্তান ও স্ত্রীর ভরনপোষণের অর্থ সহ আরো বিভিন্ন খাতের অর্থ রয়েছে।

বিরোধ নিষ্পত্তির প্রাণকেন্দ্র কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিস
ছবি : কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিসের সুবিধাভোগী একটি পরিবার

কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিসে ২০২৪ সালের আগের এডিআর আবেদন জমা ছিলো ৭১৭ টি ২০২৪ সালে আবেদন জমা পড়েছে ১৬০৯ টি। এরমধ্যে, এক হাজার ১৮৫ টি নিষ্পত্তি করা হয়। নিষ্পত্তির হার শতকরা ১৩২’৮৫% ভাগ। যদি ২০২৪ সালে এক হাজার ১৮৫ টি আবেদন এডিআর পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি না হতো, তাহলে সেখান থেকে যদি শতকরা ৫০% ভাগ আবেদন নিয়মিত মামলা হিসাবে আদালতে দায়ের হতো, তাহলে ৫৯২ টি মামলা নিয়মিত আদালতে দায়ের হতো। নিয়মিত আদালত গুলোতে ৫৯২টি মামলার অতিরিক্ত চাপ থাকতো এবং এগুলোর বিচারকার্য সম্পন্ন হতে বছরের পর বছর লেগে যেতো। এডিআর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০২৩ সালের ১২ মার্চ কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিসে একটি সুসজ্জিত মেডিয়েশন কক্ষও চালু করা হয়।

আরও পড়ুনজাতীয় আইনগত সহয়তা দিবস সোমবার 

লিগ্যাল এইড অফিসে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপোষ মিমাংসার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগও কমছে। বিচারপ্রার্থীরা মামলা চালানোর অর্থ ও মামলার দীর্ঘসুত্রীতার বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাচ্ছে। লিগ্যাল এইড অফিসে সেবাপ্রার্থী নাগরিকদের সুবিধার জন্য সিটিজেন চার্টার প্রদর্শন, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, মাতৃদুগ্ধ কর্ণার, ওয়েটিং চেয়ারের ব্যবস্থা, টিভি মনিটরে লিগ্যাল এইড বিষয়ক ডকুমেন্টারি প্রদর্শন, পৃথক মিডিয়েশন রুম, নাগরিকদের ধারণা লিপিবদ্ধ করতে লিগ্যাল এইড রেজিস্ট্রার, পরামর্শ বক্স স্থাপন ইত্যাদি কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিসকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে এবং সেবার মান বাড়িয়েছে। এককথায় কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিস এডিআর পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে।

কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিসে এডিআর এর মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে একদিকে, নিয়মিত আদালত গুলোতে মামলার জট কিছুটা হলেও কমছে, অন্যদিকে, বিচারপ্রার্থীরা সহজে, কোন খরচ ছাড়া ও কমসময়ে সেবা পাচ্ছে। বিরোধে জড়িত পরস্পর পক্ষগুলোর মধ্যে বিরোধও থাকছেনা। যা সমাজে অস্থিরতা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির কার্যক্রম খুবই গণমূখী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তবে কক্সবাজারের লিগ্যাল এইড কার্যক্রমকে আরো অধিকতর গতিশীল করতে হলে প্রয়োজনীয় জনবল সাপোর্ট দিতে হবে। বিশেষ করে লিগ্যাল এইড অফিসে বেঞ্চ সহকারী, হিসাব সহকারী, অফিস সহায়ক নিয়োগ দিতে হবে। রেকর্ড রুম, ওয়েটিং রুম সহ প্রয়োজনীয় রুমের ব্যবস্থা করা দরকার। ইউনিয়ন, উপজেলা পরিদর্শন, প্রান্তিক পর্যায়ে গণশুনানি, উঠান বৈঠক, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাতায়াত, ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে প্রয়োজনীয় ট্রান্সপোর্ট সুবিধা দেওয়া দরকার।

লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও প্যানেল আইনজীবী, কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি।