সিরাজ প্রামাণিক : সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের জানার দরকার যে, বিচারকের আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির প্রতিকার মানববন্ধন নয় কিংবা প্রতিবাদ সভা নয় কিংবা দাবী আদায়ের প্লাটফর্ম আদালত চত্ত্বরও নয়। একমাত্র প্রতিকার আইনী প্রক্রিয়া মেনে সংশ্লিষ্ট আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে প্রতিকার চাওয়া। বিচারক আসামীকে জামিন দিয়েছেন। সেকারণ তাঁর পদত্যাগের দাবীতে সংক্ষুব্ধ পক্ষ আদালতের সামনে বিক্ষোভ করবেন, বিষয়টি মোটেই শোভনীয় নয়। স্বাধীন বিচার বিভাগে নগ্ন হস্তক্ষেপের একটি জ্বলন্ত উদাহরণও বটে। আমি কারও পক্ষে-বিপক্ষে লিখছি না। আইনের কথা বলছি মাত্র।
কুষ্টিয়ার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট গোপাল চন্দ্র সরকার এর বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, কুষ্টিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলকারীদেরকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ও আওয়ামীলীগের ক্যাডার আব্দুল মান্নানকে শুক্রবার রাতে কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশ গ্রেফতার করে পরদিন শনিবার কোর্টে চালান করেন। ছুটির দিনে সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন গোপাল চন্দ্র সরকার। তিনি নাকি অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আওয়ামী লীগের ক্যাডার মান্নানকে জামিনে মুক্তির আদেশ দেন। এ জামিনের প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন কুষ্টিয়ার ছাত্রজনতা। রোববার (২৭ এপ্রিল) কুষ্টিয়া আদালত চত্বরে জড়ো হয়ে তার জামিন বাতিল ও জামিনের সঙ্গে জড়িত এ বিচারকের শাস্তির দাবি করে মানববন্ধন করেন। এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট গোপাল চন্দ্র সরকারকে বিচারিক আদালতে আর দেখা যায়নি।
ম্যাজিস্ট্রেট গোপাল চন্দ্র সরকারের বিচারিক কর্মে হাতে খড়ি বেশী দিনের নয়। পাকা-পোক্ত হতে একটু সময় লাগবে এ কথাও সত্য বটে। কুষ্টিয়া আদালতে আমি একজন নিয়মিত প্র্যাকটিশনার ল’ইয়ার হিসেবে অধিকাংশ বিচারকদের দক্ষতা, স্বক্ষমতা, একপেশে আচরণ, জয় বাংলা, মা-মাটি দেবতা, জয়শ্রীরাম-এসব বিষয়ে আমি বেশ ওয়াকিবহাল। এই গোপাল সরকার একসময় খোকসা আমলী আদালতের দায়িত্বে ছিলেন। সেসময় খোকসা থেকে যত ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে’ আসামী গ্রেফতার হয়ে আসছে তাৎক্ষণিক তিনি জামিনে মুক্তির আদেশ দিয়ে প্রসংসা কুড়িয়েছেন। এককথায় আওয়ামীলীগের কোনো ব্যক্তি গ্রেফতার হয়ে আসলে গোপাল বাবুর মাথা ঠিক থাকত না-একথা চিরন্তন সত্য। কারও প্রশ্ন থাকলে সেসময়ের জামিনের আদেশগুলো দেখলে তা সত্য হয়ে উঠবে। এ বিচারক আইনাঙ্গনে ভুক্তভোগীদের কাছে ফ্যাসিস্টের বড় দোসর হিসেবেও বেশ পরিচিত।
অসংখ্য মৌলিক আইন গ্রন্থের প্রণেতা মরহুম গাজী শামসুর রহমান বলেছিলেন, কোন মানুষ ভ্রমের ঊর্ধ্বে নয়, সম্ভবত বিচারকও নয়। বিচারকের ভ্রম ধরিয়ে দিতে পারে শুধু সেই ব্যক্তি যিনি জ্ঞানে, গুণে, মর্যাদায় এবং অবস্থানে বিচারকের সমকক্ষ। সেই ব্যক্তিই অ্যাডভোকেট। কাজেই আমার চোখে বিচারক গোপালের এ ভ্রমটুকু ধরা দিতেই পারে।
এবার জেনে নিই জামিন কী? জামিন অর্থ আইনগত হেফাজত থেকে কোন ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া। আরও সহজ করে বলতে গেলে, কোন লোককে পুলিশের হেফাজত হতে মুক্ত করে জামিনদারের হাতে অর্পণ করা। আর জামিনদার এমন লোক যিনি আদালত যখনই আবশ্যক মনে করেন তখনই আসামীকে আদালতে হাজিরা করার প্রতিশ্রুতি দেন। (৫ ডিএলআর ১৫৪)।
উপরোক্ত সংজ্ঞা থেকে আমরা বলতেই পারি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলকারীদেরকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ও আওয়ামী লীগের ক্যাডার আব্দুল মান্নানকে জামিনে মুক্তি দিতে আইনে বাঁধা নেই। তবে বাঁধা আছে নীতি-নৈতিকতায় আর বাস্তব প্রেক্ষাপটে।
তবে আইন বলছে, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকতে হবে সুনির্দিষ্টভাবে। দন্ডবিধির ৩০৭ ধারায় হত্যাচেষ্টায় অপরাধ প্রতিষ্ঠার জন্য আসামী কর্তৃক কৃতকার্যের ধরণ বা প্রকৃতি, আসামীর উদ্দেশ্য এবং অভিপ্রায় থাকতে হবে। এগুলো অনুপস্থিত থাকলে উক্ত আসামী জামিন পেতে হকদার। কাজেই জামিন বিষয়ে বিচারকের প্রতি সংক্ষুব্ধ হলে বিক্ষোভ নয়, আইন অনুযায়ী আপিল, রিভিশন করার সুযোগ রয়েছে। সংক্ষুব্ধ পক্ষের দাবী প্রতিষ্ঠায় অনেকগুলো আইনী পথ খোলা রয়েছে। আসুন বিক্ষোভ নয়, পদত্যাগ দাবী নয়। আমরা আইন অনুযায়ী ন্যায্য দাবী বুঝিয়ে নিই, অধিকার প্রতিষ্ঠা করি, আরও সহনশীল হই। সকল পক্ষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
সবিশেষ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট গোপাল চন্দ্র সরকারের প্রতি নিম্নোক্ত উপদেশবাণী দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। বিচারকের নীতিমালাতে স্পষ্ট বলা আছে যে, বিচারককে ভয় ভীতির উর্ধ্বে থেকে বিচারকার্য সম্পাদন করতে হবে। বিচারক অবশ্যই ন্যায়নিষ্ঠ এবং উন্নত চরিত্রের অধিকারী হবেন। বিচারকরা এমন কোনো সংগঠনের সদস্য হবে না যা ধর্ম, বর্ণ, লিংগ ভেদাভেদের কারনে গঠিত হয়। একজন বিচারক অন্য কারও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য তার নিজের পরিচয় এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন না। বিচারককে আইনজীবী এবং বিচারপ্রার্থী জনগনের প্রতি ধ্যৈর্যশীল হবেন এবং সম্মানজনক আচরন প্রদর্শণ করবে। বিচারক বা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য কারো কাছ থেকে বিচারিক ক্ষমতার বিনিময়ে উপহার, অনুরোধ, ঋণ বা সুবিধা চাইতে পারবেন না। এক কথায় বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিয়ে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস থাকে, এমন আচরণ করতে হবে। পাশাপাশি বিচারকের ৪০ টি অনুসরণীয় নীতিমালা না পড়ে থাকলে দয়া করে পড়ে নেবেন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, আইনের শিক্ষক ও আইনগবেষক। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com