সরকারি চাকরিজীবীদের রাজপথে আন্দোলন, কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি ঠেকাতে অন্তর্বর্তী সরকার ‘সরকারি চাকরি আইন ২০১৮’ সংশোধন করে ১৯৭৯ সালের ‘সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ’-এর কিছু ধারা পুনঃপ্রবর্তনের উদ্যোগ নিচ্ছে।
নতুন সংশোধনীর মূল উদ্দেশ্য কী?
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ সংশোধনের লক্ষ্য হচ্ছে প্রশাসনে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কর্মচারীর অযোগ্যতা, অনুপস্থিতি ও বিক্ষোভের কারণে প্রশাসনের কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ায়, সরকার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা অর্জন করতে চায়।
সংশোধিত আইনে বলা হচ্ছে, কোনো সরকারি কর্মচারী দপ্তরের শৃঙ্খলা নষ্ট করলে বা অনুমতি ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে তাঁকে তদন্ত ছাড়াই মাত্র ৮ দিনের নোটিশে চাকরিচ্যুত করা যাবে। এমনকি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও নাও দেওয়া হতে পারে।
সংশোধনীতে যেসব ধারা যুক্ত হচ্ছে
সরকারি কর্মচারী বিশেষ বিধান অধ্যাদেশ ১৯৭৯-এর চারটি ধারা সরকারি চাকরি আইনে সংযোজন করা হচ্ছে। অধ্যাদেশের তিন নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারীর জন্য যেসব বিষয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে—
১. একজন কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হয়, যার কারণে অন্য কোনো সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি হয়, শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়, কর্তব্য পালনে বাধার সৃষ্টি হয়।
২. কোনো কর্মচারী যদি ছুটি ছাড়া বা যুক্তিসংগত কারণ না দেখিয়ে নিজ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন বা অন্যভাবে বিরত থাকেন এবং নিজের কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হন।
৩. কোনো কর্মচারী যদি তাঁর নিজ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন, একই সঙ্গে অন্য কর্মচারীকে কাজে অনুপস্থিত থাকতে প্ররোচিত করেন। কোনো কর্মচারীকে তাঁর কর্তব্য পালন না করতে উসকানি দেন।
৪. যদি কোনো কর্মচারী আরেক কর্মচারীকে কাজে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য পালনে নিবৃত্ত করেন। কোনো সরকারি কর্মচারী যদি এসব কর্মকাণ্ড করে থাকেন, তাহলে তিনি অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন এবং নিচের যেকোনো দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক
অধ্যাদেশের ৪ নম্বর ধারায় অপরাধের দণ্ডের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, সরকার তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারবে। সরকার চাইলে অব্যাহতি দিতে পারবে। অথবা কোনো কর্মচারীর পদের অবনমন বা বেতন কমাতে পারবে।
৫ নম্বর ধারায় বলা হয়, যখন কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য মামলা হবে, তখন নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বিশেষ আদেশবলে তাঁর বিষয়ে অভিযোগ গঠন করবেন। কর্মচারীকে নোটিশের মাধ্যমে অভিযুক্ত করে ৫ দিনের বেশি নয়, ২ দিনের কম নয়—এমন সময়ের মধ্যে কারণ দর্শানোর কথা বলা হবে। ওই কর্মচারী ব্যক্তিগত শুনানিতে ইচ্ছুক কি না, সেটি জানতে চাওয়া হবে।
অভিযুক্ত ব্যক্তি কারণ দর্শানোর পর ব্যক্তিগত শুনানিতে হাজির হলে শুনানি গ্রহণের পর যদি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে, তখন নোটিশের মাধ্যমে প্রস্তাবিত দণ্ড কেন আরোপ করা হবে না—নোটিশ জারির তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলা হবে।
নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত কর্মচারী কারণ দর্শালে অথবা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কারণ না দর্শালে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ নোটিশে উল্লিখিত দণ্ড অভিযুক্ত কর্মচারীর ওপর আরোপ করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে তদন্ত ছাড়া একজন কর্মচারীকে আট দিনের নোটিশে চাকরিচ্যুত করা যাবে।
নতুন এই উদ্যোগে কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। নাম প্রকাশ না করে প্রশাসন ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আধুনিক সমাজে এই ধরনের দ্রুত বিচারের বিধান অমানবিক ও একতরফা।
একজন জেলা প্রশাসক বলেন, “২০১৮ সালের পর যেসব কর্মকর্তা ডিসির দায়িত্বে ছিলেন তাঁদের চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর হয়নি। ফলে সরকার তাঁদের চাকরিচ্যুত করতে পারছে না। এই সংশোধনের মাধ্যমে সরকার বিকল্প পথ নিচ্ছে।”
আন্দোলনের বিরুদ্ধে বার্তা
৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সরকারবিরোধী কর্মচারীরা রাজপথে আন্দোলনে নামেন। সচিবালয়েও দেখা যায় অবস্থান কর্মসূচি ও হট্টগোল। অনেকেই পদোন্নতির দাবিতে আন্দোলনে যুক্ত হন। এতে প্রশাসনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মনে করছে, আইনটি পাস হলে এ ধরনের বিক্ষোভের অবসান ঘটবে। কেউ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে বা অন্যদের উসকানি দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: এটা কি ‘কালো আইন’?
প্রশাসন বিশেষজ্ঞ এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, “আধুনিক প্রশাসনে কেউ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকতে পারেন না, কিন্তু তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে শাস্তি দেওয়া অমানবিক।”
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, “আইনের অপব্যবহার রোধে কঠোর নিশ্চয়তা থাকতে হবে। না হলে নির্দোষ কর্মচারীরাও ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।”
কী হতে পারে পরিণতি?
-
২৫ বছর পূর্ণ না হওয়া কর্মকর্তারাও চাকরিচ্যুত হতে পারেন।
-
রাজনৈতিক মতপ্রকাশ বা ভিন্নমত পোষণ শাস্তিযোগ্য অপরাধে পরিণত হতে পারে।
-
আতঙ্ক ও অসন্তোষে প্রশাসনিক স্থবিরতা তৈরি হতে পারে।
সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের এ উদ্যোগ সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক হলেও, প্রশাসনের মধ্যে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে তুলছে। আইনটি পাস হলে এর অপব্যবহার রোধে উপযুক্ত নিয়ম-কানুন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই হবে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।