বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে সাক্ষ্যগ্রহণ ও শুনানির ক্ষেত্রে সরাসরি উপস্থিতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি, বিচার ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং করোনা-পরবর্তী অভিজ্ঞতা বিচার ব্যবস্থাকে এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে।
এ প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ২০২৫ সালের ১৪ মে এক যুগান্তকারী নীতিমালা প্রকাশ করেছে—যার মাধ্যমে ভিডিও কনফারেন্স ও অডিও-ভিডিও ডিভাইসের মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণ ও শুনানি আইনি কাঠামোর আওতায় আনতে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এই নীতিমালাটি প্রধান বিচারপতির অনুরোধে, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি মূলত ২০২০ সালের “তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার আইন” এবং ২০২২ সালের “সাক্ষ্য আইন (সংশোধন)” এর আলোকে তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে শুধু সময় ও ব্যয় সাশ্রয়ই নয়, বরং সাক্ষী নিরাপত্তা ও সাক্ষ্যগ্রহণের আধুনিকতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
নীতিমালার মূল বিষয় সমূহ
১. ভিডিও কনফারেন্সে সাক্ষ্যগ্রহণ ও শুনানির আইনগত স্বীকৃতি: নীতিমালা অনুযায়ী, আদালত এখন ভিডিও কনফারেন্স বা অডিও-ভিডিও প্রযুক্তির মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণ করতে পারবে। সাক্ষীর সরাসরি উপস্থিতি বাধ্যতামূলক নয়, যা পেশাগত ব্যস্ততা কিংবা নিরাপত্তাজনিত কারণে সাক্ষ্য প্রদানকে সহজ করবে।
২. ডিজিটাল সাক্ষ্যের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা: ২০২২ সালের সাক্ষ্য আইনের সংশোধনী অনুযায়ী, ডিজিটাল রেকর্ড (যেমন: সিসিটিভি, অডিও/ভিডিও ক্লিপ, কম্পিউটার জেনারেটেড ডকুমেন্ট) আইনি প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য। নতুন নীতিমালায় এসব উপাত্ত আদালতে উপস্থাপন করার পদ্ধতি ও গাইডলাইন সুস্পষ্ট করা হয়েছে।
৩. সাক্ষ্যগ্রহণের নির্ধারিত স্থান ও সমন্বয়কারী কর্তৃপক্ষ: যেখান থেকে সাক্ষী ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেবেন, সেটি হতে হবে আদালত কর্তৃক অনুমোদিত স্থান। বিদেশ থেকে সাক্ষ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দূতাবাস, হাই কমিশন বা কনস্যুলেটে একটি নির্ধারিত কক্ষ ব্যবহার করতে হবে এবং সেখানে নিযুক্ত একজন কর্মকর্তাকে সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করতে হবে।
৪. প্রযুক্তি ব্যবহারে গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা বিধান: ভিডিও সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে কোনো অননুমোদিত ব্যক্তি বা রেকর্ডিং ডিভাইসের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আদালতের পূর্বানুমতি ছাড়া ভিডিও বা অডিও সংরক্ষণ বা শেয়ার করা দণ্ডনীয়। এতে সাক্ষ্যের নিরপেক্ষতা ও নৈতিকতা বজায় থাকবে।
৫. সাক্ষ্যগ্রহণ সংক্রান্ত অডিও-ভিডিও রেকর্ডের নিরাপত্তা: ডিজিটাল রেকর্ড আদালতের নির্ধারিত নিরাপদ মাধ্যমে সংরক্ষণ করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বা IT টিম কর্তৃক এ রেকর্ড যাচাই করে সংযুক্ত করা হবে।
৬. বিশুদ্ধতা ও প্রমাণযোগ্যতা নির্ধারণের নীতি: যদি ডিজিটাল প্রমাণের বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন না উঠে, তাহলে তা সরাসরি গ্রহণযোগ্য। তবে বিশুদ্ধতা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মৌখিক স্বীকৃতি দিয়ে বা আইটি বিশেষজ্ঞের সহায়তায় তা প্রমাণ করতে পারবেন।
নীতিমালার সীমাবদ্ধতা : বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ: বধির, বোবা, প্রতিবন্ধী বা মানসিকভাবে অসুস্থ সাক্ষীদের জন্য প্রযুক্তিগত বা মানবিক সহায়তা বিষয়ে কোনো স্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। এটি একটি বড় ঘাটতি।
প্রযুক্তি অবকাঠামোর ঘাটতি: দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের আদালতগুলোতে উচ্চমানের ভিডিও কনফারেন্স প্রযুক্তি, ইন্টারনেট সংযোগ বা প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা এখনো সেভাবে গড়ে উঠেনি।
আইনজীবীদের প্রশিক্ষণ: ভিডিও কনফারেন্সে সাক্ষ্যগ্রহণ পরিচালনার জন্য আইনজীবীদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
ব্যবহারিক পরামর্শ আইনজীবীদের জন্য
• আদালতের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে ভিডিও সাক্ষ্যগ্রহণের আবেদন করার সময় সাক্ষীর অবস্থান, সময়, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে হবে।
• সাক্ষ্যগ্রহণের সময় ভিডিও রেকর্ডিং বা ট্রান্সক্রিপ্ট আদালতের নির্দেশ অনুসারে সংরক্ষণ করতে হবে।
• ডিজিটাল প্রমাণ উপস্থাপনের সময় “ডিজিটাল ট্রেইল” ও মেটাডেটা সংরক্ষণ করে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পরিশেষে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ১৪ মে ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত এই নীতিমালা আমাদের বিচার ব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। এটি শুধুমাত্র সময় ও খরচ সাশ্রয়ই নয়, বরং প্রযুক্তির সহায়তায় আরও ন্যায়সংগত, নিরাপদ ও আধুনিক বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।
আইনজীবী ও বিচারকদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়িয়ে, অবকাঠামো উন্নয়ন করে এবং সময়োপযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই নীতিমালার সফল বাস্তবায়ন সম্ভব।
এই নীতিমালা প্রযুক্তির জগতে বিচারের স্বচ্ছতা ও প্রাসঙ্গিকতা নিশ্চিত করার জন্য একটি সময়োচিত ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ, যা ভবিষ্যতে ‘ডিজিটাল জাস্টিস’-এর বাস্তবায়নে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে।
সংকলনে : অ্যাডভোকেট বোরহানউদ্দিন খান, আইনজীবী, জজ কোর্ট, ফেনী