এক.
৫ অক্টোবর, ২০১৯।
কেরানীগঞ্জের নিঃস্তব্ধ মধ্যরাতে, ধূসর এক পুরনো ভবনের চতুর্থ তলায় হঠাৎ কড়া নাড়ে পুলিশের একটি ছোট দল। নেতৃত্বে আছেন সাব-ইন্সপেক্টর আশরাফ আলী।
মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এই পুলিশ কর্মকর্তা অসাধারণ মানবিক বোধের অধিকারী। কোনো আসামিকেই তিনি ‘তুই’ বলে অপমান করেন না। বরং অপরাধ তদন্তের সময় তিনি প্রথমেই খুঁজে ফেরেন সেই মানসিক প্রেক্ষাপট, যার ভেতর থেকে অপরাধ জন্ম নেয়।
দরজা খুলতেই আলো-আঁধারির রেখায় ধরা পড়ে এক যুবকের মুখ—জাহিদ হাসান জোভান।
ধুলো জমা সস্তা টি-শার্ট, মুখজুড়ে অগোছালো দাড়ির ছায়া, ক্লান্ত চোখে লালচে রেখা আর চাহনিতে একরকম বিস্মিত ফাঁপা শূন্যতা।
— “আপনিই জাহিদ হাসান জোভান?”
— “…আমি কী করেছি, স্যার?”
— “আপনাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে—কুড়িগ্রামের কিশোরী শশীকে ধর্ষণের অভিযোগে।”
মেয়েটির মায়ের অভিযোগ, ১১ সেপ্টেম্বর তার মেয়ে প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছিল। পথেই জোভান ও তার সহযোগী আবির হোসেন তাকে জোরপূর্বক মোটরসাইকেলে তুলে নেওয়া হয় একটি মোবাইল সার্ভিসিং দোকানে। সেখানেই চালানো হয় যৌন নির্যাতন।
অভিযোগের কথা শুনেও জোভানের মুখে কোনো অপরাধবোধের ছাপ নেই। উল্টো একরকম আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে ওঠে—
“স্যার, আমি তো কিছু করিনি। আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। ভালোবাসা কি অপরাধ?”
কিন্তু, মেডিকেল রিপোর্ট, ভুক্তভোগীর জবানবন্দি—সবকিছুতেই রয়েছে তার অপরাধের সুস্পষ্ট ছায়া। আশরাফ আলী কথা না বাড়িয়ে জোভানকে থানায় নিয়ে আসেন।
পরদিন জিজ্ঞাসাবাদে আসামি ছিল অদ্ভুত রকমের নির্লিপ্ত, যেন সমস্ত দায়-দায়িত্ব থেকে সে এক কাঠের পুতুল।
— “জোভান, আমাদের রিপোর্ট বলছে—আপনি অতীতেও গ্রেপ্তার হয়েছেন।”
— “জি স্যার। আপনি জানেন না আমি কে? আমি সেই ছেলে, যার নাম একসময় খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল। কিন্তু কাগজে তো বুকের ভেতরের দহন লেখা থাকে না।”
এই একটুখানি বাক্যে কেঁপে ওঠে আশরাফ আলী। সিডিএমএস রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে নিশ্চিত হন—হ্যাঁ, এই জোভানই সেই ব্যক্তি, যার বিরুদ্ধে ২০০২ সালে একটি কিশোরী মৃত্যুর ঘটনায় গোটা দেশ একদিন গর্জে উঠেছিল।
দুই.
১৭ জুলাই, ২০০২।
চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া সুলতানা তিথীর বয়স তখন মাত্র ১০ বছর। কুড়িগ্রামের এক ছোট শহরে তার স্বপ্নেরা খেলা করত—স্কুল, বন্ধু আর পরিবারের নির্ভরতায় গড়া এক শিশুবিশ্বে। কিন্তু কিছু বিকৃত মানসিকতার মানুষের ছোঁবলে সে স্বপ্নভুবন অকালেই নিভে যায়।
তিথীর প্রতিবেশী বখাটে জোভান (১৯), রায়ান (২০) ও শামীম (১৯) প্রায়ই তাকে উত্ত্যক্ত করত। নিরাপত্তাহীনতায় তার পরিবার একপর্যায়ে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘ বিরতির পর, আবার স্কুলে ফিরতেই নেমে আসে সর্বনাশ।
সেদিন স্কুল শেষে বাড়ি ফেরার পথে তিথী দেখতে পায়, সেই তিন দানব তার পিছু নিয়েছে। ভয়ে তার ছোট্ট দুটি পা কাঁপছিল, তবু প্রাণপণে ছুটে চলে সে—একটি সরু গলির দিকে, যার শেষ প্রান্তে ছিল একটি গভীর পুকুর। আশ্রয়ের শেষ চেষ্টাটিও ব্যর্থ হয়। ওরা তাকে ঘিরে ফেলে। আতঙ্কে অসহায় তিথী ঝাঁপিয়ে পড়ে জলে, ভুলে যায়—সে সাঁতার জানে না।
মানুষ চরম বিপদের মুহূর্তে শেষ আশাটুকু আঁকড়ে বাঁচতে চায়, উপায় না পেলে ছুটে যায় অজানার দিকেও। তিথীরও হয়েছিল তাই। ভয়ের কাছে আত্মসমর্পণ না করে সে মৃত্যুর মুখেই ঝাঁপ দিয়েছিল।
পানিতে ডুবে যাওয়ার ঠিক আগে তিথীর ছোট দুটি হাত উঠেছিল আকাশের দিকে, হয়তো বাঁচার আকুতিতে। কিন্তু চারপাশে থাকা পাষাণ হৃদয়গুলো কেবল চেয়ে চেয়ে দেখল, কেউ এগিয়ে এলো না।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিল দুজন—এক কিশোর অয়ন এবং এক প্রৌঢ়, আলতাফ মুন্সি।
খবর ছড়িয়ে পড়ে। জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। শহরজুড়ে প্রতিবাদ, আগুন, স্লোগান —“হত্যাকারীর বিচার চাই, ফাঁসি চাই।”
পুলিশ আসে, দমকল আসে। শেষে, পুকুরের গভীরতা থেকে উদ্ধার করা হয় তিথীর নিথর ছোট্ট দেহটি।
তিন.
ঘটনার পরপরই পুলিশ তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে। প্রথমে জোভান, তারপর রায়ান ও শামীমকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
জোভান তার জবানবন্দিতে জানায়, সে তিথীকে ভালোবাসত। হত্যা নয়, বরং তাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে বিয়ে করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। এ বিষয়ে সে পূর্বেই বন্ধুদের সঙ্গে পরিকল্পনা করেছিল, এবং তারাই তাকে সহযোগিতা করছিল।
কিন্তু তিথী হঠাৎ ভয় পেয়ে পালাতে শুরু করে, আর তারা তাকে অনুসরণ করে। পুকুর পাড়ে পৌঁছে, তিথী যখন তাদের কাছাকাছি দেখতে পায়, তখন আতঙ্কে পানিতে ঝাঁপ দেয়।
পরবর্তীতে রায়ান ও শামীমকেও পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া হয়, এবং দুইদিন পর তারাও অনুরূপ স্বীকারোক্তি দেয়।
পুলিশ এই তিনজনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে। কিন্তু সেই ধারার যৌক্তিকতা নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়। অনেকে মত প্রকাশ করেন—ভুল ধারায় অভিযোগ গঠনের অর্থ আসামিদের আইনি সুবিধা দিয়ে দেওয়া, অর্থাৎ তাদের রক্ষা করার সুযোগ সৃষ্টি করা।
আইন বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা সরাসরি হত্যার পর্যায়ে পড়ে না। উপযুক্ত ধারা ছিল দণ্ডবিধির ৩০৫/৩৪—যা শিশু আত্মহত্যায় প্ররোচনার সংজ্ঞায় পড়ে। তিথীকে কেউ সরাসরি হত্যা করেনি, বরং ভয় পেয়ে সে নিজেই পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল। আসামিরা ছিল নিরস্ত্র, এবং তাদের উদ্দেশ্য যে সরাসরি হত্যার ছিল না, তা স্বীকারোক্তিতেই স্পষ্ট।
অভিযোগ গঠনের পর মামলায় মোট ২৬ জন সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়া হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে প্রসিকিউশন পক্ষ তিন আসামির সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে যুক্তিতর্ক তুলে ধরে।
প্রসিকিউশন পক্ষের প্রধান যুক্তিগুলো ছিল—
১. তিন আসামির স্বীকারোক্তি একে অপরকে সমর্থন করে, যা তাদের দোষ প্রমাণে শক্তিশালী ভিত্তি।
২. প্রত্যক্ষদর্শী অয়ন তাদের বক্তব্যকে সমর্থন করেছে।
৩. পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, ঘটনাস্থল, এবং সেখান থেকে উদ্ধারকৃত তিথীর স্কুলব্যাগ, স্যান্ডেল ও পোশাক—সবই মৃত্যুর সরাসরি প্রমাণ বহন করে।
অন্যদিকে, আসামিপক্ষ উপস্থাপন করে—
১. স্বীকারোক্তিগুলো সত্য ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নয়।
২. রিমান্ডে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে।
৩. আসামিরা কেউ তিথীকে পানিতে ঝাঁপ দিতে প্ররোচিত করেনি।
৪. তারা কেউ ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার হয়নি।
৫. একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী অয়নের সাক্ষ্য নির্ভরযোগ্য নয়।
উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক ও সাক্ষ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ মাত্র ছয় মাসের মধ্যে মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়—তিনজনের বিরুদ্ধেই দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় আনীত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আদালত তাদের সবাইকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
চার.
জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া তিন আসামি আপিল করেন হাইকোর্ট বিভাগে। শুনানিতে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন। তাদের বক্তব্য ছিল—সেশন কোর্টে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়নি, এবং আসামিরা মৃত্যুদণ্ডের উপযুক্ত নন।
তাদের যুক্তিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল:
১. আসামিদের মধ্যে পূর্বপরিকল্পনার প্রমাণ নেই; তাই ধারা ৩৪ অনুযায়ী ‘সাধারণ অভিপ্রায়’ প্রযোজ্য নয়।
২. তিথীর মৃত্যু ছিল একটি দুর্ঘটনা, যা অপহরণের চেষ্টার সময় ঘটেছিল; কাজেই বিচার হওয়া উচিত ছিল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে, ট্রাইব্যুনালে। সেশন কোর্টের এখতিয়ার ছিল না।
৩. এটি কোনো ইচ্ছাকৃত হত্যা নয়, বরং অনিচ্ছাকৃত নরহত্যা—তাই ৩০২ নয়, বরং ৩০৪(ক) ধারা প্রযোজ্য।
৪. আসামিদের বয়স ছিল ষোল বছরের নিচে—স্কুল সার্টিফিকেট ও ইউপি চেয়ারম্যান প্রদত্ত সার্টিফিকেট দিয়ে তা প্রমাণিত হয়েছে। কিশোরদের বিচার কিশোর আদালতে হওয়া উচিত ছিল।
৫. তারা প্রথমবারের মতো অপরাধ করেছে, তাদের জন্য লঘুদণ্ডই যথার্থ।
তবে মাননীয় হাইকোর্ট এসব যুক্তি নাকচ করে দেন। রায়ে বলা হয়—এই অপরাধকে ‘অবহেলা’ বা ‘তাড়াহুড়ার কাজ’ বলা যাবে না। এটি ছিল ইচ্ছাকৃত কার্যকলাপ, যার ফলাফল সম্পর্কে অভিযুক্তরা সচেতন ছিল। তারা জানত, তাদের কাজ তীব্র ঝুঁকিপূর্ণ। কাজেই এটি সরাসরি খুনের শামিল।
হাইকোর্ট আরও বলেন—সাধারণ অভিপ্রায় যে কোনো মুহূর্তে গঠিত হতে পারে। ঘটনাস্থলে তিথীকে ধাওয়া করে, তার মধ্যে ভয় তৈরি করে তাকে আত্মরক্ষার জন্য ঝাঁপ দিতে বাধ্য করায় সেই অভিপ্রায়ের জন্ম হয়। তারা কেউ তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি, বরং নিঃশব্দে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। এই নিস্তব্ধ নিষ্ঠুরতায় তিনজনই সমভাবে দায়ী।
আদালত স্পষ্ট ভাষায় বলেন—কম বয়স হলেও অপরাধের প্রকৃতি ভয়াবহ, নির্মম ও রুদ্ধশ্বাস। বয়স কোনো ছাড় নয়। ফলে, মৃত্যুদণ্ডই তাদের ন্যায্য ও উপযুক্ত শাস্তি।
হাইকোর্ট এই পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জেলা জজের দেওয়া রায় বহাল রাখেন। এরপর মামলাটি গড়ায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে।
সুপ্রিম কোর্ট রায়ে বলেন—তিথীকে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২(খ) ধারা অনুযায়ী ‘অপহরণ’ হিসেবে গণ্য হয়। এই ধাওয়ার মধ্যে স্পষ্ট হুমকির উপাদান ছিল, ফলে আসামিরা ওই আইনের ৭ ধারায় অপরাধ করেছে।
একজন মাননীয় বিচারপতি অপরাধটি অপহরণ হিসেবে মেনে নিলেও শিশু আইনের উপর বিস্তর আলোচনা করে বলেন, আসামী শামীমের বয়স অপরাধ সংঘটনের সময় ১৬ বছরের কম ছিল। তার অভিযোগপত্র ও বিচার বয়স্কদের সাথে না হয়ে পৃথক হওয়া উচিত ছিল।
তিনি অভিমত দেন, বিচারকদের আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অপরাধীর আইনগত অধিকার খর্ব করা সমীচীন নয়। তাই আসামি শামীমের ক্ষেত্রে শিশুবিষয়ক আইন প্রযোজ্য এবং তাকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের সাজা প্রদানের সুপারিশ করেন।
দীর্ঘ এই আইনি লড়াই শেষে, অন্যান্য আসামিসহ জোভানের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে ১৪ বছরের কারাদণ্ডে রূপান্তরিত হয়। সে মুক্তি পায় ২০১৭ সালে।
পাঁচ.
৮ অক্টোবর, ২০১৯। সাব-ইন্সপেক্টর আশরাফ আলী আবার জিজ্ঞাসাবাদ করছেন সেই পুরনো অপরাধী জোভানকে। ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত থেকে তিনি পাঁচ দিনের রিমান্ড আদেশ পেয়েছেন।
“আমি নতুনভাবে শুরু করতে চেয়েছিলাম। জেলখানায় বসে ভাবতাম, নতুন জীবন শুরু করব। কিন্তু কেউ সে সুযোগ দিল না, স্যার। ভিতর থেকে চিৎকার করেছি—‘আমি আর সেই মানুষটা না।’ কেউ শোনেনি। শশীকে অনেক বোঝাইছি, সংসার করতে চেয়েছি, সে রাজি হয় নাই। তখন মনে হইল—যদি সবাই আমাকে দানব ভাবে, তাহলে দানবই থাকি।”
আশরাফ চুপচাপ শুনছেন।
— “জোভান, তওবা করুন, নিজের অপরাধ স্বীকার করুন। যে তওবা করে, সে গুনাহ থেকে মুক্ত হয়; যে অনুতপ্ত হয়ে দোষ স্বীকার করে সে অপরাধমুক্ত হয়।”
— “তওবা করেছি বহুবার, স্যার।”
— “কিন্তু তওবা মানে আবার সেই অপরাধে ফিরে যাওয়া নয়। আপনি ইচ্ছাকৃতভাবেই বারবার বড় অপরাধ করছেন।”
— “না স্যার, শুধু প্রেমে ব্যর্থ হলেই অপরাধে সফল হয়ে যাই।”
— “তাই বলে ধর্ষণ?”
— “ধর্ষণ তো করি নাই, স্যার। শুধু এমন কলঙ্ক দিয়েছি, যাতে আর কোথাও বিয়ে না হয়। আর জেলখানায় তো দেখছি কোর্টই এক সময় বিয়ে করায়!”
জোভানের এই কথায় স্তব্ধ হয়ে যান আশরাফ। কীভাবে একজন মানুষের মনে এমন বিকৃত ধারণা জন্মায়! দুটি মেয়ে— একটি মৃত্যু, একটি ধর্ষণ। অথচ, জোভানের চোখে ভয় নেই, ঠোঁটে কৌতুক, কণ্ঠে অনুশোচনার লেশমাত্র নেই।
তিনি মেলানোর চেষ্টা করেন— কেন একজন লোক কঠোর শাস্তির পর আবারও অপরাধ করে বসে? তিনি মনে মনে প্রশ্ন রাখেন:
“যদি তাকে ২০০২ সালেই ঠিকভাবে রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রামে পাঠানো হতো, তবে কি আজকের এই দিনটা আসত?”
তার মনে পড়ে, অপরাধের পুনরাবৃত্তি নিয়ে জাপানের আরেক ভয়াবহ কাহিনি—জুনকো ফুরুতা কেস।
ছয়.
১৯৮৮ সালে ১৭ বছর বয়সী জুনকো ফুরুতা স্কুল থেকে ফেরার পথে হিরোশি মিয়ানোর নের্তৃত্বে চার কিশোর তাকে অপহরণ করে। পরবর্তী ৪৪ দিনে তাকে প্রতিদিন অগণিতবার ধর্ষণ করা হয় এবং পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাদের অপরাধের বিভীষিকা গোটা বিশ্ববাসীকে কাঁপিয়ে দেয়।
বিচারে প্রধান অভিযুক্ত হিরোশি মিয়ানো পায় মাত্র ২০ বছরের সাজা। অন্যান্যরা ৫-১০ বছরের মধ্যে ছাড়া পায়।
পরবর্তীতে তারা কেউই অপরাধ থেকে দূরে থাকেনি, বরং মিয়ানো ২০০৯ সালে মুক্তি পেয়ে আবার ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার হয়। অন্যরাও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
এই কেস একটি নির্মম সত্য প্রমাণ করে—যদি শাস্তি অপর্যাপ্ত হয়, যদি সংশোধনমূলক ব্যবস্থা যথেষ্ট না থাকে, যদি মুক্তির পর অপরাধীর ওপর নজরদারি না রাখা হয়—তাহলে অপরাধ ফিরে আসে। পুনরাবৃত্ত হয়। এবং তখন তা আরও ঠান্ডা মাথায়, আরও ভয়ংকর রূপে হাজির হয়।
সাত.
রিমান্ডের পাঁচ দিন শেষে, আজ জোভানকে কোর্টে তোলা হচ্ছে। আবারও নারী নির্যাতনের মামলা। তবে এবার আর ‘অপহরণ’ নয়—সরাসরি ‘ধর্ষণ’।
আশরাফ আলীর জিজ্ঞাসাবাদের পর সে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তি দেওয়ার আগ্রহ দেখায়। কিন্তু আদালতে গিয়ে সে সটান অস্বীকার করে দেয়।
প্রিজন ভ্যানে ওঠার আগে সে মুচকি হেসে বলে—“এমনে এমনে তো ১৪ বছর জেলে থাকি নাই, স্যার। আইনের ফাঁক-ফোকরও শিখে গেছি।”
আশরাফ বোঝেন—সতেরো বছর আগের সেই অন্ধকার কখনোই মুছে যায়নি। শুধু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও প্রশস্ত হয়েছে। বুঝতে পারেন— গল্পটা শুধু জোভানের ছিল না। এটা এমন এক সমাজের গল্প, যেখানে ভিকটিমরা হারিয়ে যায়, আর অপরাধীরা ফিরে আসে—নীরবে, ছায়ার মতো, ধীরে, নিশ্চিতভাবে।
[বি.দ্র. বাস্তব মামলার আলোকে নির্মিত সাহিত্য; পুলিশ-আসামির কথোপকথন ও চরিত্রের নাম-পরিচয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে।]
লেখক : মো. সাইফুল ইসলাম পলাশ, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী।